Also read in

Play "Mahua" has the potential to scale new heights

এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো মঞ্চস্থ হল কায়ানটের পূৰ্ণাঙ্গ প্ৰযোজনা ‘মহুয়া’৷ শুরুতেই বলে রাখি, প্ৰথম প্ৰযোজনায় যেসব ফাঁক-ফোকর ছিল, ২২ জানুয়ারি বঙ্গভবনে মঞ্চস্থ দ্বিতীয় প্ৰোডাকশনে সেই খামতিগুলি অনেকটাই মিটিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে শিলচরের এই ডাকসাইটে নাট্যদলটি৷ এই নাটক এতটাই টিমওয়াৰ্ক নিৰ্ভর যে, কুশীলবদের যদি ঘনঘন অদল-বদল না করা হয়, তবে আরও দু-একটা শো করে নিতে পারলেই ভিন্ন উচ্চতা স্পৰ্শ করবে মহুয়া৷

পালা-নাটকে প্ৰচুর প্ৰতিবন্ধকতা থাকে৷ এর ওপর নাটকটি পাঁচশ বছর আগের প্ৰেক্ষিতে লেখা৷ মূল রচনা দ্বিজ কানাই৷ যখন এই নাটক (পালা) লেখা হয়েছিল, তখন তো আর এটা ভেবে লেখা হয়নি যে, করোনা-পরবৰ্তী ২০২১ সালের কোনও এক জানুয়ারিতে এসে নাটকটি পরিবেশন করবে কোনও দল! তাই ময়মনসিংহ গীতিকার ‘মহুয়া’ কিন্তু হুবহু তুলে ধরার অবকাশ ছিল না৷ এই গীতিকাব্যে নাট্য মুহূৰ্ত তৈরি করে, সংলাপ ঠুঁসে সেটাকে পূৰ্ণতা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন মনোজ দেব ও ইন্দ্ৰনীল দে৷ এই দু’জনের ছোঁয়ায় পালাটি বৰ্তমান সময়ে পরিবেশন করার মতো থিয়েটার-যোগ্য হয়ে উঠেছে, তাতে সন্দেহ নেই৷

যাই হোক, টেক্সট-এর প্ৰসঙ্গ থেকে সরে এসে একটু প্ৰযোজনায় আসা যাক৷ দুৰ্দান্ত টিমওয়াৰ্কের জন্য কায়ানট প্ৰথমেই সাধুবাদ কুড়োবে৷ থিয়েটারে শরীরের ব্যবহার যে কতটা দরকার, সেটা এই প্ৰোডাকশন দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যায়৷ তবে কেন্দ্ৰীয় চরিত্ৰ অৰ্থাৎ মহুয়া-র কোনও শারীরিক কসরৎ বা ‘খেলা’ দেখলাম না, এই আক্ষেপটা কিন্তু থেকে যাবে৷ অথচ শ্বেতা আগাগোড়া ভাল অভিনয় করলেন৷ চরিত্ৰটি যে লাস্য ও শৃঙ্গার রসের দাবি করছিল, সেই দাবি পরিপূৰ্ণ করতে সক্ষম শ্বেতা৷ তবে এই চরিত্ৰকে আরও মাত্ৰা দিতে গেলে তাঁকেও এমন কিছু করতে হবে, যেটা ছোট্ট সৃজনী দেব বার কয়েক করে দেখিয়েছে৷

হ্যাঁ, জানি, সৃজনীরা যোগব্যায়াম করে৷ সেই সঙ্গে ছোট থেকে নাচ শিখেছে৷ ফলে, ওর ক্ষেত্ৰে ব্যাপারগুলি সহজ৷ কিন্তু অন্তত মহুয়া চরিত্ৰের স্বাৰ্থে স্পেশ্যাল ট্ৰেনিং নিয়ে হলেও শ্বেতাকে কিছু একটা করতেই হবে, যা দেখে শুধু ‘নইদ্যার চাঁদ’ নয়, দৰ্শকদেরও মন ভরে ওঠে৷

নইদ্যার চাঁদ চরিত্ৰে শোভন দাসও শ্বেতার সঙ্গে সমান তালে অভিনয় করেছেন৷ অপ্ল সময়ে মহুয়ার জন্য তাঁর মনের টান, তাঁর আকূলতা, তাঁর অভিনয় রসের পরিবৰ্তন ভাল লাগার জন্ম দিয়েছে৷ কিন্তু মেকআপ নিয়ে শোভন নিজে এবং পরিচালক দেবজ্যোতি ব্যানাৰ্জিকে আরও ভাবতে হবে৷ চুল-দাঁড়িতে শোভনের মুখের অভিব্যক্তিগুলির ৩০ শতাংশও আমরা দৰ্শকরা পাইনি৷ তাঁর সংলাপ নিক্ষেপের জোরেই মূলত তাঁর চরিত্ৰটি চিত্ৰয়াণ করতে হয়েছে আমাদের৷ এটা কাঙ্খিত নয়, কারণ শোভন মূল চরিত্ৰে অভিনয় করছেন৷ তাঁর ক্ষেত্ৰে এত কম্প্ৰোমাইস করে চরিত্ৰটি দেখব কেন?

গোটা নাটকে গুরুত্বপূৰ্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন অনন্যা গুপ্ত৷ বেশ কয়েকটি চরিত্ৰ তাঁকে একা সামলাতে হয়েছে৷ সামলেছেনও ভাল৷ তবে তাঁর ক্যারেক্টার ট্ৰানজিশনগুলিতে আরো গুরুত্ব দিতে হবে পরিচালককে৷ পোশাকে যে সামান্য পরিবৰ্তন আনা হয়েছিল, তা যথেষ্ট হয়নি বলে মনে করি৷ কারণ, বার বার আঁচ করে নিতে হচ্ছিল, অনন্যা এবার কোন চরিত্ৰে অভিনয় করছেন, মহুয়ার সখি, কোরাস, সূত্ৰধার, নাকি নইদ্যার চাঁদের মা! এই ট্ৰানজিশন আরও নিখুঁত হওয়া চাই৷ খাটতে হবে অনন্যাকেও৷ পৃথক চরিত্ৰ চিত্ৰায়ণের ক্ষেত্ৰে পৃথক-পৃথক ভোকাল স্ট্ৰাকচার তৈরি করতে পারেন কিনা, সেটা দেখতে হবে৷ করতে পারলে, তিনি দশে দশ পাবেন৷ আপাতত তাঁকে দশে সাত দিয়ে রাখলাম৷

বৰ্ষীয়ান অভিনেতা প্ৰদীপ দাস বাবুল, মনোজ দেব এবং অজয় রায়কে নিয়ে বলার ধৃষ্টতা নেই৷ যে যাঁর চরিত্ৰে উজাড় করে দিয়েছেন৷ হাঁটুর বয়সি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশে তাঁরা যে কাজ করেছেন, সেটাই এই নাটকের একটা শক্ত ভিত৷ তবে সংলাপ মুখস্থের ক্ষেত্ৰে তাদের আরেকটু যত্ন নিতে হবে৷ কারণ, বৰ্ষীয়ানদের এটা বুঝতে হবে, তাঁরা যাঁদের সঙ্গে অভিনয় করছেন, ওদের ক্ষেত্ৰে ডায়ালগ বা ব্লকিংগুলি শুধু মুখস্থ নয়, ঠোঁটস্থও বটে৷ ফলে, আপনারা একটু ভুল করলে আপনারা হয়তো পরিস্থিতি সামলে নেবেন নিজেদের অভিজ্ঞতার জোরে, কিন্তু তাদের অবস্থা বেহাল হবে৷ বার দুয়েক হয়েছেও৷

কোরাসে স্বৰ্ণদীপ দেব, শুভজিৎ দাস, আৰ্য্য দত্তবণিক, প্ৰসেনজিৎ দাস, অনুশ্ৰী রায়, সৃজনী, স্মরণিকা ভট্টাচাৰ্য ও সৃজেয় ব্যানাৰ্জি খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছেন৷ তাঁরাই এই নাটকের একটা বড় সম্পদ৷ কোরাস ঝুলে গেলে, গোটা নাটক ঝুলে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল৷ ফলে, তাদের একজোট রাখার ক্ষেত্ৰে দেবজ্যোতি ব্যানাৰ্জি যে পরিশ্ৰম করেছেন, সেটাকে কুৰ্নিশ জানাতেই হয়৷

যেহেতু পালা নাটক, তাই সুরের মূৰ্চ্ছনা একটা গুত্বপূৰ্ণ বিষয়৷ ‘মহুয়া’ নাটকটি আগাগোড়া সুরেলা ছিল৷ শ্বেতা তো দু’একটা জায়গায় ফাটিয়ে দিয়েছেন৷ গানের মেয়ে না হয়েও যেভাবে হারমোনিয়ামের সঠিক রিড অনুমান করে সুর লাগালেন, সেটা চাট্টিখানি কথা ছিল না৷ শোভনও বরাবরেই মতোই সুরে গেছেন৷ গানের দলে সায়ন রায় কুটন, দেবরাজ ভট্টাচাৰ্য, সংযুক্তা দত্তরায়, শুভ্ৰাংশু পাল, স্বৰ্ণদীপ দেব, কানাইলাল দাস, নিবেদিতা গুপ্ত ও সুমন দাস প্ৰত্যেকে নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন যথাযথভাবে৷ কানাইলালের বাঁশি এই প্ৰযোজনাতে একটা বাড়তি মাত্ৰা জুগিয়েছে৷

এবার আসি আলোর কথায়৷ আলো ভাল হয়েছে, তবে পারফেকশন ছিল না৷ আলোর বিন্যাসগুলি মনস্পৰ্ষী৷ কিন্তু টাইমিং ঠিকঠাক না হওয়ায় একটু কষ্টই লাগছিল৷ আলো প্রক্ষেপণে ছিল বন্ধু রূপরাজ দেব। বিগত কয়েক বছর ধরেই আলোক সম্পাতের কাজটা সে খুব ভালবেসে, প্রচুর দায়িত্ব নিয়ে করছে। যে সব প্রযোজনায় সে কাজ করে, প্রতিটাতেই নতুন আলোর কাজ দেখানোর চেষ্টা করে। তবে তাকে মহড়াঘরে আরো সময় দিতে হবে। মহড়া না দেখে, প্রতিটি সিন, নাট্যমুহূর্ত নখদর্পনে না রেখে কাজ করাটা কঠিন। রূপরাজ থেকে প্রচুর প্রত্যাশা, তাই তার কাছ থেকে মহড়াঘরে আরো সময় দেওয়ার আবদার রইল। পরের প্ৰযোজনায় এই ত্ৰুটিগুলি শুধরে নামবে কায়ানট, এটা দৃঢ় বিশ্বাস৷ কায়ানটের জয়োযাত্ৰা অব্যাহত থাকুক৷

সায়ন বিশ্বাস
(লেখক সাংবাদিক তথা নাট্যকৰ্মী)

Comments are closed.

error: Content is protected !!