
Play Review: Kistimaat by Bhabikal and Ajker Projonmo
গত ২০শে এপ্রিল রবিবার শিলচর বঙ্গভবনে মঞ্চস্থ হলো নাটক ” কিস্তিমাত”
মূল নাটক: স্লিউথ
নাট্যকার: এন্থনি শেফর
সন: 1970
অনুবাদ: কল্পিতা দেব
আবহ নির্মাণ: সুদীপ্ত চক্রবর্তী সৌম্য ( কলকাতা)
আবহ প্রক্ষেপণ: মাধুর্য্য চৌধুরী
লাইভ আবহ: শোভন দাস
সার্বিক আবহ পর্যবেক্ষণে: সেবায়ন রায় চৌধুরী
আলো: রূপরাজ ধর
মঞ্চ : অঙ্কন কংসবণিক
রূপসজ্জা: স্বপন কান্তি কর ও শ্বেতা রায়
সহকারী নির্দেশক: সায়ন্তনী মিঠি
প্রপ্স: শুভ্রা দাস
নাটকটি যেহেতু অনুবাদ তাই নাম পরিবর্তনের সাথে এখানে নাটকের প্রেক্ষাপটও বদলে দেওয়া হয়েছে। পুরো নাটকটি শিলং এ দেখানো হয়েছে।
যেদিন প্রথম কিস্তিমাত এর পোস্টার রিলিজ হলো শিলচরবাসী প্রথম সাক্ষী হলেন নাটকের পোস্টার রিলিজ এর। তারপর এক এক করে টিকিট রিলিজ থেকে শুরু করে মঞ্চস্থ হওয়া পুরোটাই নতুন আলোর পথ দেখালেন তরুণ নির্দেশক সায়ন বিশ্বাস ও তার তরুণ তুর্কির দল। দুটো দল আজকের প্রজন্ম ও ভাবীকাল যৌথ উদ্যোগে প্রযোজনাটি মঞ্চস্থ করলেন । অনলাইনে টিকিট কিনে নাটক দেখতে গেলেন শিলচরের মানুষ !! অভাবনীয়! এক কথায় বলতে গেলে আমরা এক নতুন যুগের শুরুর সাক্ষী হতে পারলাম।
পকেটের টাকা খরচ করে নাটক করার দিন শেষ। এবার ভালো ভালো নাটক মঞ্চস্থ করুন ।দর্শক টাকা দিয়ে টিকিট কিনে নাটক দেখতে তৈরী। ।তবে হ্যাঁ শুধুমাত্র নাটকের ইতিহাসে আপনার নিজের নাম নথিভুক্ত করতে এপিক নাটক মঞ্চস্থ করলে চলবেনা। নাটকের গুনগত মান নিয়ে ভাবতে হবে ; দর্শক নিয়ে ভাবতে হবেনা। দর্শক তৈরী এখন নাটকের। ভালো নাটক চাই শুধু।
নির্দেশক সায়ন বিশ্বাস ইতিমধ্যেই আমাজিং গার্ল বা নৌকাডুবির মতো নাটক আমাদের উপহার দিয়ে আমাদের কিস্তিমাত নিয়েও আশা বাড়িয়েই রেখেছিলেন। সেদিনও দর্শকরা অধির আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলেন মঞ্চের পর্দা কখন খুলবে। এর মধ্যেই অঝোর ধারায় বৃষ্টি। তারপরও ৬টার মধ্যে দর্শকাসন প্রায় ভর্তি। হাতে ছাতা নিয়ে অডিটরিয়ামে প্রবেশ করছেন দর্শক। ভাবা যায়!
এবার আসি নাটকের গল্পে-
“স্লিউথ” হলো ব্রিটিশ নাট্যকার এন্থনি শাফার-এর লেখা একটি সাসপেন্স-থ্রিলার নাটক, যা 1970 সালে প্রকাশিত নাটকের গল্পটি একটি দ্বিপাক্ষিক মানসিক খেলা (mind game) ঘিরে আবর্তিত।বিখ্যাত রহস্য উপন্যাস। কিস্তিমাত তারই রূপান্তর ও অনুবাদ করেছেন সায়ন ও কল্পিতারা।এই নাটকে লেখক অর্ধেন্দু রায় চৌধুরী তার স্ত্রীর প্রেমিক মিলন মন্ডলকে তার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানায়। তবে এটা বন্ধুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎ নয়—অর্ধেন্দু আসলে মিলনকে একটি বিপজ্জনক খেলায় জড়িয়ে ফেলে। প্রথমে সে মিলনকে বোঝায় যে তারা একটা সাজানো চুরির নাটক করবে যাতে স্ত্রীকে খুশি করার জন্য মিলন অর্থ পাবে। কিন্তু ঘটনাটা ধীরে ধীরে ভয়ানক মোড় নিতে থাকে।
নাটকের মাঝখানে এসে বোঝা যায়, এই খেলাটা শুধুই প্রতিহিংসা, ঈর্ষা আর মনস্তাত্ত্বিক দখলের একটি লড়াই। কে কাকে হারাতে পারে, কে কাকে প্রতারিত করছে—এই দ্বন্দ্বে নাটক এগিয়ে যায়।
নাটকটির প্রধান আকর্ষণ দুই চরিত্রের মধ্যকার বুদ্ধির লড়াই।রয়েছে টুইস্ট, হিউমার, থ্রিল, এবং নাটকীয় সংঘর্ষ। নাটক টি নিয়ে আগেই চরম উৎসাহ তৈরী হয়ে গেছিলো দর্শকদের মনে কারণ এতো সুন্দর পাবলিসিটি হয়েছে নাটকের যে সবার মুখে মুখে কিস্তিমাতের নাম ছিলো। তাই সবার মতো আমিও সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হবার অপেক্ষায় ছিলাম যে কখন পর্দা খুলবে!
মঞ্চের পর্দা খুলতে শুরু করলো একটা দারুন সুন্দর আবহ দিয়ে। একটু একটু করে পর্দা সরছে আর মন বলছে আহা! কি দারুন ! কি দারুন! অঙ্কনের মঞ্চ তৈরীর কাজ আমরা আগেও দেখেছি অনেক বার কিন্তু এবার যেনো আরো এক ধাপ এগিয়ে। মঞ্চের এক একটা জিনিষ যেনো কথা বলছিলো। নাটকের মঞ্চে যা প্রপস রাখা হয় নাটকের ব্যাকরণ বলে সেগুলো যেনো নাটকের প্রয়োজনে বা ব্যবহারে থাকে। সত্যিই একটা জিনিষও শুধুমাত্র সৌদর্য্য বৃদ্ধির জন্য রাখা হয়নি। ড্রয়ার ঘড়ি গ্লাস চেয়ার টেবিল সব কিছু কোনো না কোনো ভাবে নাটকের প্রয়োজনেই ছিলো এবং ব্যবহারও হয়েছে। অংকন আবারো অবাক করা কাজ করে দেখালো। এক কথায় প্রথমেই মঞ্চ মন কেড়ে নিলো। তবে নির্দেশক সায়ন কি মঞ্চের সামনের দরজা টা নিয়ে একটু ভাবতে পারেন?!
প্রথম দৃশ্যে মঞ্চে ছিলেন অর্ধেন্দু রায় চৌধুরী ( সুব্রত রায় শম্ভু) এই অঞ্চলের নাট্যপ্রিয় দর্শকদের কাছে এক অতি পরিচিত নাম। এবং ব্যক্তিগত ভাবে আমার খুব প্রিয় একজন অভিনেতা। কিন্তু সেদিন অর্ধেন্দু রূপে সুব্রত রায় যা করে দেখালেন সেটা দর্শকের দীর্ঘদিন মনে থাকবে। কোথাও কোনো অতি অভিনয়ের চেষ্টা নেই।একেবারে সাবলীল সংলাপ নিক্ষেপ। নেই কোনো অপ্রয়োজনীয় অঙ্গভঙ্গি।এতো পরিশীলিত এবং পরিমিত অভিনয় ! কি অসাধারণ মডিউলিউশন! সত্যিই প্রভূত প্রশংসার দাবি রাখে। আমার দেখা উনার শ্রেষ্ঠ অভিনয়।
মিনিট ৫ পরে মঞ্চে প্রবেশ ঘটলো মিলন মন্ডলের ( শান্তনু পালের) এই অঞ্চলের আরেকজন অতিপ্রিয় অভিনেতা শান্তনু পালের।উনি মঞ্চে প্রবেশ করেই যেনো নিজেই ভুলে গেলেন উনি শান্তনু। উনি তখন পুরো মিলনমন্ডল হয়ে উঠেছেন। উনার চলা বলা উনার মানারিজম । কখনও ভীতু প্রেমিক আবার কখনও লোভী । দর্শদের দীর্ঘদিন মিলন মন্ডলকে মনে থাকবে।তবে উনার ডায়লগ ডেলিভারির এক বিশেষ ভঙ্গি আছে যা মাঝে মাঝেই উঁকি দিচ্ছিল অভিনয়ে। ওটা একটু ভাবতে পারেন।এক কথায় সেদিনের মঞ্চে দুই অভিজ্ঞ অভিনেতা যেনো নাটকের চরিত্রের মতোই একে অপরকে টেক্কা দিচ্ছিলেন। কেউ ১৯ নয় কেউ ২০ নয় দুজনই ১০০/১০০।
মঞ্চে আলোর ব্যবহার দিয়ে ইতিমধ্যেই রুপরাজ অনেকবার প্রশংসা এবং পুরষ্কার দুই ই কুড়িয়েছেন। কিস্তিমাত এর দুর্দান্ত আলো যেনো এক একটা দৃশ্যকে জীবন্ত করে তুলেছিলো।রূপরাজ সেদিন আলোর খেলা দেখালো অর্ধেন্দু আর মিলনের খেলার সাথে।
আবহ নির্মাণ করেছেন আমাদের সকলের প্রিয় এবং গর্ব সুদীপ্ত চক্রবর্তী সৌম্য। সেই সুদূর কলকাতা বসে। আমরা নৌকাডুবিতে তার দারুন ভালো আবহ আজ ও মনে রেখেছি।
কিস্তিমাত এর আবহও খুব ভালো হয়েছে। তবে যেহেতু এটা একটা থ্রীলার আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে যে সায়ন মিউজিক নিয়ে আরো একটু ভাবতে পারেন।
নির্দেশক সায়ন বিশ্বাস এবারও আবার দেখিয়ে দিলেন কি করে “কিস্তিমাত” করতে হয়। আর বাজিমাত করলেন এক ঝাঁক তরুণ তুর্কিরা। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমকে সমস্ত দর্শকের তরফ থেকে কুর্নিশ জানাই।
এভাবেই বার বার ভালো ভালো নাটক হোক। আর জয় হোক নাটকের।
অভিজ্ঞ আবৃত্তিকার ও অভিনেত্রী
Comments are closed.