Also read in

"Pora shuna kore je, gaari ghura chore she"- is it really so?

The English version of the story will be uploaded soon.

পড়াশুনা করে যে গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে! আদৌ কি তাই ?

বরাক উপত্যকার অধিকাংশ মা-বাবা ছেলেমেয়েকে এই প্রবাদটি বলে থাকেন বাল্য কালে। এইটার অন্য মানে হলো, জীবনে “বড়লোক” হতে হলে, পাঁচতারা হোটেলে বসে খেতে হলে বা বিদেশ ভ্রমণের স্বপ্ন সাকার করতে হলে পড়াশুনাই একমাত্র উপায়। পড়াশুনা একান্ত প্রয়োজনীয়  এবং তা নিয়ে শিক্ষিত-প্রগতিশীল সমাজে কোনো তর্ক হতে পারে না, তবে পড়াশুনা কি আদৌ আর্থিক সমৃদ্ধির বা স্বপ্নপূরণের একমাত্র উপায়?

ছোটবেলা থেকেই পড়াশুনাকে প্রধান করে তুলতে অভিভাবকরা নানান প্রচেষ্টা চালিয়ে যান আর এর মধ্যে একটি হলো পড়াশুনাকে জীবনে আর্থিক সক্ষমতার একমাত্র উপায় হিসেবে প্রতিপন্ন করা। আজ সারা অসম বা সমগ্র ভারতবর্ষ হিমা দাসের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, ইতিহাসের পাতায় হিমা দাসের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।নিশ্চয়ই সে প্রশংসার যোগ্য, হিমার দৌড় স্বাধীন ভারতকে ট্র্যাক ইভেন্ট থেকে প্রথম সোনা এনে দিলো। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী থেকে আরম্ভ করে অমিতাভ বচ্চন, সচিন টেন্ডুলকার সবাই আজ হিমাকে সংবর্ধনা জানাতে ব্যস্ত। কেউ কি জানেন হিমা মাধ্যমিকে অঙ্কে কত পেয়েছে? বা সে বিজ্ঞানে লেটার পেয়েছে কি না,কারোর কি জানার প্রয়োজন আছে যে হিমা আদৌ মাধ্যমিকে বসেছে কি না? ভারতের পতাকা হাতে নিয়ে মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্বর্ণপদক গ্রহণ করে বিশ্বের সামনে নিজের জাতীয় সংগীতকে তুলে ধরার চেয়ে বড় সাফল্য আর কি কিছু হতে পারে?

এক কৃষকের ঘরে যদি হিমা গড়ে উঠতে পারে তবে সোনারের মেয়ের সমৃদ্ধি বা সাফল্যের ঠিকানা শুধু ইস্কুলই হবে কেন? কেন ইন্সপেক্টর বা গেজেটেড অফিসারের মেয়ের জন্য পড়াশুনাই গাড়ি-ঘোড়া লাভের একমাত্র উপায়? হিমার কৃষক বাবা এমন কি বুঝে নিলেন যা ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তার বাবারা বুঝতে পারলেন না বা পারছেন না? হিমা আর অন্য ইনা, মিনা, ডিকার মধ্যে কোনো পাৰ্থক্য নেই, পার্থক্যটা  হলো  অভিভাকত্বের। ইঞ্জিনিয়ার বাবার এন্ট্রান্স এক্সামিনেশনের ফর্মুলা মুখস্থ করার পথও চেনা, তাই নিজের প্রজন্মকে একই পথ অনুসরণের পরামর্শ দেন বা ক্লার্ক চান নিজের মেয়েকে অফিসার করে গড়ে তোলার, কৃষক মূর্খ হিমার বাবার কাছে পরামর্শের খুবই অভাব তাই তার ফর্মুলা ছিল যা ভালো লাগে কর আর এই ফর্মুলা থেকেই সৃষ্টি হয় হিমা, পি ভি সিন্ধু, সাইনা নেহওয়াল, সানিয়া মির্জা, শ্রেয়া ঘোষালদের।আর সাফল্য,সমৃদ্ধি, প্রশংসা বা বিশ্ব খ্যাতির ক্ষেত্রে অনেক কম পড়াকু স্কলার, ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার তাদেরকে ছাড়িয়ে যেতে পারছে এবং পারবে।

অধিকাংশ বাবারাই ফুটবল বিশ্ব কাপ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, কেউ আর্জেন্টিনার রাউন্ড অফ সিক্সটিন থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার পোস্টমর্টেম করেছেন, কেউ বা আবার চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মেসি আর ম্যারাডোনার মধ্যে কে ভালো সেই তর্ক আজও চালিয়ে যাচ্ছেন, অনেকে আবার ফ্রান্সের দ্রুতগতির প্রশংসা করছেন।  ব্রাজিলের ছন্দ আর স্পেনের টিকি-টাকা রাশিয়ায় কাজ না করলেও বাবাদের সকালে প্রেসারের ঔষধের বাক্সে আক্ষেপ হয়ে এখনো রয়েছে। ফুটবল বিশ্বকাপেতো ভারত অংশও নিতে সক্ষম হয় না তাও এই বিশ্ব কাপ নিয়ে এতো উন্মাদনা? অল্প ঘুরিয়ে বললে, এতো উন্মাদনা থাকা সত্তেও ১২৫ কোটির মধ্যে ২৩ জন প্রতিভাশালী ফুটবলারের একটা দল গড়ে উঠতে অক্ষম হয় কেন ভারত? জন্মের এক দিন পর মেসি-রোনাল্ডো যা মিনটু – ঝনটুও তা, পার্থক্যটা হলো মেসি- রোনাল্ডো রাস্তার মোড়ে বল নাচালে ওদের বাবা ওদের কে নিয়ে একাডেমিতে ভর্তি করায় আর মিনটু – ঝনটুর বাবা রাস্তার মোড়ে ওদের ফুটবল খেলতে দেখলে, গর্জে বলে “মেরে ঠেং গোড়া করে দেব, যা পড়তে বোস্।” শুধু বাবা নয় এতে মায়েরাও আছেন, মেসি-রোনাল্ডোরা পা কচকালে ওদের মা গরম শেক দিয়ে ওদের আবার মাঠে পাঠিয়ে দেয়, মিনটু – ঝনটুর মা আমার সোনা ছেলে বলে আঁচলে আগলে ধরে আর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “ফুটবল মাঠের রাস্তা ভুলে যা বাবা, ওসব খেলে কোনো লাভ নেই, অংক কর্, লেটার পাবি।”

যেমন ভারতের ফুটবলে দুরবস্থা তেমনি আসামের ক্রিকেটেও একই হাল।  আইপিএল এ দুশোরও বেশি প্লেয়ার ভাগ নেয়, তার মধ্যে ১০০ র বেশি ডোমেস্টিক ট্যালেন্ট, ভারতের ১১ তো দূরের কথা আইপিএলের ১০০ র মধ্যে আসামের একটা ক্রিকেটারও জায়গা করে উঠতে পারে না।  কারণ? গোড়ায় গন্ডগোল ! পড়াশুনায় যেমন শ্রেণী রয়েছে খেলায়ও তেমনি অনেক বিভাগ আছে, বিশ্ব বিখ্যাত ফুটবলার জিনেদিন জিদান যখন গত বছর ভারতে এসেছিলেন তখন এক সাংবাদিক তাকে জিজ্ঞাসা করেন, ভারতে ফুটবলের এই অসহায় অবস্থা কেন, কেন ভারত ওয়ার্ল্ড ক্লাস ফুটবলার সৃষ্টি  করতে পারে না? উত্তরে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জিদান বলেছিলেন, খেলোয়াড়ের যাত্রা শুরু হয় ৩ বছর বয়স থেকে, ৩ থেকে  ৭ বছরের মধ্যে তার প্ৰিয় খেলা চিহ্নিত করা হয়। মেসি যায় ফুটবল মাঠে, সচিন যায় ক্রিকেট পিচে, ৭ থেকে ১০ বছর অব্দি হয় খেলোয়াড়ের শিক্ষা, ১০ থেকে ১৪ বছর অব্দি খেলোয়াড় তার শিক্ষার প্রয়োগ করে আর ১৫ থেকে সে প্রফেশনাল হয়ে ওঠে।জিদান বললেন, “খেলোয়াড় সৃষ্টি হয় না, খেলোয়াড়কে গড়ে তুলতে  হয়, ৬ বছর অব্দি সব সমান কিন্তু ১৫ বছর এ শুরু করলে কেউ মেসি বা নেইমার হতে পারবে না।” সত্যি তো টেন্ডুলকার ১৬ বছর বয়সে ওয়াসিম আক্রম, ওয়াকার ইউনিস এর মতো এক্সপ্রেস বাউলারদের ছক্কা হাঁকিয়ে বেড়াচ্ছিল।

আর অর্থনৈতিক দিক থেকে খেলোয়াড়রা পিছিয়ে নেই কিন্তু, বিশ্বকাপের যখন উল্লেখ হলো তাহলে তারকাদের দৈনিক আয় নিয়ে অল্প আলোচনা হোক।  রোনাল্ডো রিয়াল মাদ্রিদ থেকে ইতালিয়ান ক্লাব জুভেন্টাসে যাওয়ার খবর টা ‘লেটেস্ট ‘ বলে হোয়াটস্যাপে নিশ্চয় পেয়েছেন সবাই, তার জুভেন্টাসে দৈনিক আয় হবে ভারতীয় মুদ্রায় ৬৬লক্ষ, নেইমার যে ফ্রান্সের প্যারিস সেইন্ট জারমেইন ক্লাবের হয়ে খেলে তার দৈনিক আয় হচ্ছে ৮০ লক্ষ টাকা, মেসিও পিছিয়ে নেই, স্পেনের ক্লাব বার্সেলোনা তাকে দিনে ৬৬ লক্ষ টাকা দেয়, তারপর রয়েছে ব্র্যান্ড এনডোর্সমেন্ট, বোনাস এবং আরো অনেক আমদানি। টাকা শুধু ফুটবলে নয়, ক্রিকেটেও আছে, ভারতের অধিনায়ক বিরাট কোহেলির  ২০১৭ সালে আয় ছিল ১০১ কোটি টাকা তাতে রয়েছে বিসিসিআই কন্ট্রাক্ট, উইনিং বোনাস (ম্যান অফ দা ম্যাচ ইত্যাদি) আর ব্র্যান্ড এনডোর্সমেন্ট।

তাই পড়াশোনা করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে-কথাটাকিন্তু আদৌ সত্যি নয়, আসলটা ঠিক উল্টো, পড়াশোনা করে গাড়ি ঘোড়া চড়া বা বিদেশ ভ্রমণ করা খুবই কঠিন। পড়াশোনা করে ন্যাশনাল পত্রিকায় কাজ করা সাংবাদিক একটি ওলা বা উবের গাড়ি চালক থেকে মাসে  কম টাকা রোজগার করে। রানারের মতো সারা শহর ঘুরে খবর সংগ্রহ করে রাতের মধ্যে লিখে আপনার সকালের পত্রিকায় যে খবর পৌঁছে দেয় তার থেকে ওই পেপার এ ঠোঙা বানিয়ে যে চানাচুর বিক্রি করে সেও মাসে বেশি রোজগার করে, পড়াশুনা করে ক্যারিয়ার গড়ে তোলা সহজ বটেই, তবে গাড়ি ঘোড়া বা দিল্লি হয়তবা দূর অস্ত্।

Comments are closed.