Shabnam Surita shares experience of traveling to Kolkata from Germany during pandemic
“বাড়ি ফিরতে এত ভয়!” করোনার মাঝে জার্মানি থেকে কলকাতা ফেরার অনুভূতি লিখছেন শবনম সুরিতা ডানা
আশায় আশায় বসে ছিলাম কবে ভারতের পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হবে আর আমি বাড়ি যেতে পারব। কিন্তু তা হতে হতে যে দশ মাস লাগবে, তা ভাবিনি। পাঁচ বছর ধরে বিদেশ থাকি, কিন্তু দশ মাসের বেশি সময় কখনোই দেশের বাইরে একটানা থাকিনি। তবে এমনিতে আমি খুব একটা ‘হোমসিক’ মানুষ নই। কথায় কথায় হাত-পা ছড়িয়ে ‘মা, বাড়ি যাব!’ বলিনা। কিন্তু এই যে একটা অদ্ভুত পরিস্থিতি গোটা বিশ্বজুড়ে, সেটাই আমাকে খুব অধৈর্য্য করে তুলছিল। তাই যেই দেখলাম যে ভারতে যাবার প্লেন জার্মানির সাথে চালু হয়েছে, সোজা ফোনে ধরলাম আমার বিশ্বস্ত ট্র্যাভেল এজেন্টকে, আর আস্তে আস্তে মনে মনে ভারতের আকাশে নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগলাম। করোনা সংকটে যখন ভারত রীতিমত বিধ্বস্ত, এমন একটা সময়ে আমি যে এত সহজেই দেশে আসতে পারব, ভাবিনি। হয়তো ভারত বলেই তা সম্ভব হয়েছে।
আগস্টের দু’ তারিখ যখন জানলাম যে ভারতের সাথে ফ্রান্স, জার্মানি ও নেদারল্যান্ডস ‘এয়ার বাবল’ চালু করেছে, আনন্দের চোটে মনে হচ্ছিল একছুটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাশের রাইন নদীতে গলা ডুবিয়ে বসে থাকি। কিন্তু তা করিনি। মাথা ঠাণ্ডা রেখেছি। চারদিকে সবাই অনেক ভয় দেখিয়েছে, মানা করেছে। ভয় পাওয়াও স্বাভাবিক। আমি যখন জার্মানি থেকে ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিচ্ছি, তখন জার্মানিতে দৈনিক করোনা সংক্রমণের সংখ্যা ৯০০ থেকে ১২০০’র মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। আর ভারতে সেই সংখ্যাই ৯০,০০০। তাছাড়া, আমার স্বাস্থ্যবীমা ভারতে এসে করোনায় আক্রান্ত হলে আমার খরচ বহন করবে না, কারণ আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের বারণ সত্ত্বেও ‘হাই রিস্ক এরিয়া’-তে গিয়েছি। আমিও ভয় পেয়েছি ঠিকই, কিন্তু কাউকে বুঝতে দিইনি। মাথা ঠাণ্ডা রেখে চুপচাপ প্ল্যান বানিয়েছি। সেই প্ল্যানটাই বলি আগে।
প্রথম স্টেপ ছিল টিকিট কাটা, যেটা নিয়ে আমায় একদম ভাবতে হয়নি। ট্র্যাভেল এজেন্ট, শুভকাকু, টিকিট কেটে পাঠিয়ে দিল। খালি একটাই চিন্তা, প্লেনে চাপতে আমাকে যেতে হবে আমস্টারডাম, যা আমার শহর থেকে রেলপথে চার ঘণ্টা। জার্মানির জাতীয় এয়ারলাইন লুফটহানসার বিমানে আমস্টারডাম-মিউনিখ-দিল্লি। এই ছিল আমার যাত্রাপথের প্রথম ভাগ, আর তারপর ডোমেস্টিক ভাগটুকু ইন্ডিগোর বিমানে দিল্লি থেকে কলকাতা। আমস্টারডাম যেতে কোনো বাধা নেই, কারণ আমি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাসিন্দা, ফলে এই অঞ্চলে চলাফেরা করতে কোনো ভিসা বা অনুমতি লাগবে না। সমস্যা ভারতে প্রবেশ করা। করোনা সংকটের চরমে থাকার কারণে ভারতে প্রবেশ করতে কিছু বিশেষ নিয়ম কানুন মেনে চলতে হবে। এছাড়া, যদি প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারান্টিন না করতে চান কেউ, সেক্ষেত্রে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করার ৯৬ ঘণ্টা আগে করোনা পরীক্ষা করতে হবে যাত্রীকে। সেই ফলাফল নেগেটিভ আসলেই ভারতে ঢুকতে পারবেন সেই যাত্রী। অন্যথায় ১৪ দিনের কোয়ারান্টিন।
প্রথম দিন থেকেই আমার লক্ষ্য ছিল কোয়ারান্টিন এড়ানো। কারণ, হাতে বেশি ছুটি নেই। এর মধ্যে যদি ১৪ দিন অজানা, অচেনা এক ঘরের মধ্যেই কেটে যায়, তাহলে মা-বাবা-ভাই-বরের সাথে থাকব কবে? ইন্টারনেট ঘেঁটে বের করলাম আমার সবচেয়ে কাছের করোনা টেস্টিং সেন্টার, যাত্রা শুরুর ৯৬ ঘণ্টা আগে পরীক্ষা করার অ্যাপয়েন্টমেন্টও নিয়ে নিলাম। এরপর শুধুই অপেক্ষা। কবে আসবে সেই দিন! তো যাই হোক, তিনি এলেন এবং আমিও মহানন্দে ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এখানে একটু বলে নিই, প্লেন ধরতে জার্মানি থেকে আমস্টারডাম যাওয়া কিন্তু অত সহজ নয়। তার ওপর আমায় দুটো চাকরি করতে হয় বলে সেসব সামলে যাওয়ারও একটা বিষয় ছিল। তার ওপর চারতলার বাড়িতে থাকি, লিফট নেই। তাই আগের রাতেই এক বন্ধুর সাহায্য নিয়ে লাগেজ সিঁড়ির তলায় নামিয়ে রাখলাম। পরদিন ১৪ সেপ্টেম্বর ভোরবেলা স্নান করে লাগেজ নিয়ে বাসট্রাম বদলে অফিস। এরপর বিকেলে ট্রেনে আমস্টারডাম যাব, কিন্তু অফিস করতে করতেই খবর পেলাম আমার ফ্লাইট প্রিপোন হয়েছে, অর্থাৎ নির্ধারিত সময়ের ১২ ঘণ্টা আগেই ফ্লাইট ছেড়ে দেবে। আর আমার হাতে সময় মাত্র ছয় ঘণ্টা! এর মধ্যে অফিস সেরে কীভাবে আমস্টারডাম পৌঁছাব ভাবতে না ভাবতেই আমার সহকর্মীরা এগিয়ে এলেন সাহায্য করতে। কোনোমতে নাকে মুখে দুটো খেয়ে, বাকি কাজ যতটা পারি সামাল দিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা দৌড় দিলাম স্টেশনের উদ্দেশ্যে। পথে টুক করে করোনা নেগেটিভ রিপোর্টটাও তুলে নিতে ভুললাম না। ওটাই যে আমার সব!
আমি কোথাও যাব আর আমার সাথে কিছু উল্টোপাল্টা হবে না, এটা অসম্ভব। এবারও তাই হলো। স্টেশনে পৌঁছে দেখি কোনো ট্রেন নেই। দূরে কোন এক স্টেশনে এক যাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ায় সব ট্রেন অন্তত কয়েক ঘণ্টা বিলম্বিত। কোনোমতেই ট্রেনে করে পৌঁছানো সম্ভব না। কী করব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মাথা প্রচণ্ড গরম হয়ে গেল, ফোন লাগালাম লুফটহানসাকে। ঝড়ের বেগে গালাগাল করে আমার টিকিট পাল্টালাম যাতে আমায় আমস্টারডাম না যেতে হয়। সোজা মিউনিখ থেকেই যাতে দিল্লির ফ্লাইটে উঠতে পারি, সেই ব্যবস্থা করলাম। ট্রেনে চেপে বন থেকে সাত ঘণ্টার পথ মিউনিখ। সকাল ৭টায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে নানা কাণ্ড করে মিউনিখ যখন পৌঁছলাম, তখন রাত এগারোটা কুড়ি। এয়ারলাইনকে ফোন করে আগেই হোটেলের ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম। হোটেলে পৌঁছে স্নান করে বিছানায় শুয়ে শুয়ে তখন আমি ভাবছি আহ, এর পরের রাতে আমি ভারতে! হোক না দিল্লি এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে, তবু ভারতে তো!
সকাল উঠে আর দেরি করলাম না, এক দৌড়ে এয়ারপোর্ট। চেক-ইন, লাগেজ ড্রপ সব করে মনের সুখে ডিউটি-ফ্রি দোকানে কেনাকাটা, কিছু টুকটাক খাবারও খেলাম। মিউনিখ এয়ারপোর্ট দেখে এটুকুই মনে হলো যে করোনাকে হয়ত হারিয়ে দেওয়া গেছে। সবাই নিয়ম মেনে মাস্ক পরছে, নিজ দায়িত্বে দূরত্ব বজায় রাখছে, কেউ কারো গায়ে উঠছে না, ধাক্কাধাক্কি নেই, বাথরুমও একটু পরপর স্যানিটাইজ করা হচ্ছে। দেখে আশ্বস্ত হলাম। আর আরও আশ্বস্ত হলাম বোর্ডিং গেটের সামনে গিয়ে। সেখানে প্রতিটি দিল্লিগামী যাত্রীর কাগজপত্র, করোনা সার্টিফিকেট, শরীরের তাপমাত্রা সব চেক করা হচ্ছে। প্লেনে যাত্রীসংখ্যা কম বলে নির্ধারিত আসন বদলে দূরে দূরে বসানো হচ্ছে সবাইকে যাতে করে আরেকটু আরামে, নিশ্চিন্তে যাত্রা সম্পন্ন করা যায়। শুধু বোর্ডিং গেটেই নয়, প্লেনের ভেতরেও যাত্রীদের ব্যবহারে মুগ্ধ হলাম। আসলে এতদিনের বিমানযাত্রার অভিজ্ঞতায় কোনোদিন দেখিনি যে প্লেন থামছে অথচ হাজার বারণ সত্ত্বেও ভারতীয় যাত্রীরা উঠে লাগেজের জন্য হুড়োহুড়ি করছে না। অথচ এই আচরণ আর কোনো দেশে দেখিনি। কিন্তু এবারই প্রথম ভারতীয়দের এমন করতে দেখলাম, মুগ্ধ হলাম। কিন্তু সেই মুগ্ধতা ক্ষণস্থায়ী হবে কে জানত!
দিল্লি পৌঁছে নিয়মমাফিক সার বেঁধে প্লেন থেকে নামলাম সবাই। কার কার কোয়ারান্টিন এড়ানোর অনুমতি আছে জিজ্ঞেস করে আলাদা সারিতে দাঁড় করানো হলো। করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট ব্যাগ থেকে বের করতেও হলো না আমায় একটিবারের জন্যেও। দূর থেকে কাঁচের ওপারে থাকা কর্মীকে ‘কোয়ারান্টিন এক্সেম্পশন’ নথির স্ক্যান মোবাইলে দেখালাম। উনি কতটুকু দেখলেন তা নিয়ে আমার ঘোর সন্দেহ। মুহূর্তের মধ্যেই হাতে লাগল ‘স্টেট কোয়ারান্টিন’ স্ট্যাম্প। বলা হলো, এবার আমরা নিজ নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ডোমেস্টিক ফ্লাইট ধরতে যেতে পারি। আমার সামনে দুটি ছেলে ভুবনেশ্বর যাবে, কিন্তু অফিসারকে ভুল করে বলেছে যে দিল্লিতেই থাকবে। তার হাতে ‘কোয়ারান্টিন’ স্ট্যাম্প। নো প্রবলেম, দু’ফোঁটা জল ঢেলে একটু রগড়াতেই স্ট্যাম্পের অস্তিত্ব হাপিশ। অন্য লাইনে গিয়ে ‘দাদা, আমার স্ট্যাম্পটা উঠে গেছে, আমি ভুবনেশ্বর যাব’ বলতেই আমার মতো ‘স্টেট কোয়ারান্টিন’ স্ট্যাম্প জুটে গেল তার। হাসতে হাসতে বলল, “ওয়েলকাম টু ইন্ডিয়া”। আমি হাসলাম না, বিরক্ত হলাম কিছুটা। আইন ভেঙে এত গর্ব!
এরপরের ৫ ঘণ্টা নিয়ে বিশেষ কিছুই বলার নেই। চুপচাপ ঠায় বোর্ডিং গেটের সামনে বাধ্য মেয়ের মতো বসেছি। কিন্তু কলকাতাগামী ফ্লাইটের সময় যত কাছে এসেছে, চারপাশে মানুষের হাবভাব, নির্লিপ্ততা দেখে শুরু হয়েছে আমার অবাক হবার পালা। প্লেনে ওঠার আগে মাঝের সিটে বসা লোকদের পিপিই কিট দেওয়া হলো। বাকিদের সবাইকে দেওয়া হলো মাস্ক, ফেস শিল্ড ও স্যানিটাইজার। যুদ্ধং দেহী সাজে উঠলাম প্লেনে। উঠে দেখি ও হরি! এখানে তো বেজায় ভিড়! আর শুধু ভিড় হলে তাও একটা কথা ছিল। গোটা যাত্রাজুড়ে আমার সামনের বয়স্ক যাত্রী নিজের মাস্ককে ঠোঁটের ওপর ঝুলিয়ে জোরে জোরে কাশলেন। ফল হলো এই, আমি প্লেনে এক সেকেন্ডের জন্যেও মাস্ক নামালাম না। কিন্তু এই ভয়ও অল্পের জন্যেই। দু’ঘণ্টা পর যখন আস্তে আস্তে কলকাতার ঘোলাটে আকাশ, নিচের নদী, গাছপালা, সারি সারি বাড়ি দেখতে পেলাম, তখন সব ভয় গায়েব! প্লেন মাটি ছুঁতেই লুফটহানসার বিমানযাত্রায় ভারতীয়দের নিয়ে করা গর্বের বেলুন স্রেফ চুপসে গেল।
ইন্ডিগোর বিমানবালারা বারবার বলছেন, “আপনারা বসুন, প্লেন এখনও থামেনি! এভাবে উঠবেন না। আমরা সারি অনুযায়ী আপনাদের নামাবো! দূরত্ব বজায় রাখুন!” কে শোনে কার কথা! বললেই হলো? আগে নামাতে হবে না লাগেজ? এটা তো রীতিমত একটা ইগোর লড়াই। একটা লড়াই তো অন্তত জিততে হবে রে বাবা, তাতে করোনা ছড়ালে ছড়াক! চুপচাপ মজা দেখলাম, তারপর নিজের সময়ে প্লেন থেকে নামলাম। গটগট করে হেঁটে লাগেজ নিলাম আর বেরিয়ে গেলাম। ব্যস। কেউ একটিবারের জন্যেও আমার হাতের স্ট্যাম্প, শরীরের তাপমাত্রা দেখতে চাইল না, কেউ জিজ্ঞেস করলো না আমার জ্বর বা অন্য কোনো লক্ষণ আছে কি না। কেউ পাত্তাই দিলো না আমার মতন এক যাত্রীকে, যাকে কিনা দুদিন আগে পর্যন্ত পাড়ায় ঢুকলে ‘এরা বাইরে থেকে করোনা নিয়ে আসে’ শুনতে হতো। তবে এখন তো গোটা পাড়াই করোনা-আক্রান্ত। খোঁটা শোনাবার মুরোদ কার আছে?
গাড়িতে চেপে বরের সাথে শহরের বাইরে একটি বাড়িতে গেলাম। পেছনের গাড়িতে ভাই, বাবা। দূর থেকেই হাত নেড়ে, মাস্ক পরেই গল্প করে কাটালাম। নিয়ম অনুযায়ী আমার এই রাজ্য থেকে বেরোনোর কথা নয় আগামী ১৪ দিন। এরমধ্যে সাতদিন বাপেরবাড়ি শ্বশুরবাড়ি কারো সাথেই দেখা করিনি। আজ সাতদিন বাদে বেরোলাম। সাবধানে থাকছি যাতে অন্য কেউ আমার জন্য সমস্যায় না পড়ে। কিন্তু ভয়? না, আমি আর ভয় পাচ্ছি না। বদলে খুব চিন্তা হচ্ছে আমার। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে সংক্রমণ জানি, অথচ দিল্লি এয়ারপোর্টে করোনা পরীক্ষার লাইনে গাদাগাদি ভিড় দেখে মনে হলো করোনা নেই। হোম কোয়ারান্টিনের জন্য ডাক্তারি পরীক্ষার লাইনের ভিড়েও একই অবস্থা। কলকাতা এয়ারপোর্টের বাথরুমের অবস্থা আগের চেয়েও খারাপ। গাড়িতে যেতে যেতে নিউটাউনের বাজার দেখলাম একটা। সেখানে কয়েকজন সচেতন, কিন্তু বেশিরভাগই হাল ছেড়ে দিয়েছেন। মাস্ক পরছেন না, দূরত্ব কোন ছাড়! দশ মাস পর করোনা সংকটে জর্জরিত ভারতকে কিছুটা অন্য রকম দেখব ভেবেছিলাম। কিন্তু আমার দেশ নিরাশ করেছে। সে তার চিরাচরিত কায়দার সাথে এতটুকু আপোষ করেনি। ৫৫ লক্ষ সংক্রমণ? মাত্র একটা সংখ্যা! তাতে কি আর নতুন করে ৭৩ বছরের দেশকে আইনকানুন মানা শেখানো যায়?
Comments are closed.