Also read in

Shops are shut, life is stunned; its chaos and carnage

থমকে পেশা, স্তব্ধ জীবনে শুধুই হাহাকার নিশাদের

১. টিমটিম করতে করতে চুলোর আগুন আজ সকালে শেষমেশ নিভেই গেল। অনিল দাসের মনে হলো, নিভে গেল যেন বেঁচে থাকার আরও একটি আশার আলো। দেড়শটা মানুষ আর অবলা কিছু প্রাণীর দায়িত্ব তাঁর ওপর, অনিল চোখে অন্ধকার দেখেন।
শুক্রবার গান্ধীমেলার ভাঙাহাট থেকে সেলফোনে অনিল বলেন, আমাদের অবস্থা একেবারে শোচনীয়। এতগুলো পেট, কিন্তু খাবার আর কিচ্ছুটি নেই। লঙ্গরখানা চালান যে দুই ভাণ্ডারি, হাত তুলে দিয়েছেন তাঁরাও। তুলবেনই তো। লকডাউন আজ এগারো দিনে পড়ল, গান্ধীমেলা বন্ধ আজ প্রায় তিন সপ্তাহ। বন্ধ রোজগারও। এই অবস্থায় চোখে অন্ধকার দেখছেন অনিল।

গুয়াহাটির বি কে এন্টারপ্রাইজ-এর গোল্ডেন সার্কাস আর ডিজিল্যান্ড মেলা নিয়ে ২৭ ডিসেম্বর শিলচর গান্ধীমেলায় এসেছেন অনিল দাস। অনিল বরপেটার হাউলির বাসিন্দা। কোম্পানির ম্যানেজার। মালিক মহম্মদ মুক্তার আলম মূলত বিহারের হলেও কয়েক দশক ধরে গুয়াহাটিতেই রয়েছেন। সারা বছর মেলায় মেলায় ঘোরেন তাঁরা। শিলচর থেকে গোল্ডেন সার্কাস যাবে অরুণাচল প্রদেশ। বায়না নিয়ে প্রোগ্রাম ফাইনাল করতে মুক্তার গেছেন অরুণাচলে। এরই মধ্যে লকডাউন। তিনি আটকে গেছেন সেখানেই, সার্কাস পার্টি শিলচরে। শুধু সার্কাস নয়, বি কে এন্টারপ্রাইজের নাগরদোলাও রয়েছে, লকডাউনে বন্দি এর সঙ্গে জড়িত কর্মীরাও।

অনিল জানালেন, সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিনশজন ছিলেন তাঁরা। ১৩ মার্চ থানা থেকে অনিলকে ফোন করে বলা হয়, মেলা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, তাঁরা যেন আর শো না করেন৷ এরপর দফায় দফায় প্রায় দুশো জন নিজেদের বাড়ি ফিরে গেছেন এতো এতো মানুষ, তাঁবুই তো কতটা, এগুলো খুলে গুছগাছ করতেও তো কতদিন লাগে। এই অবস্থায় লকডাউন। ব্যস, দুর্ভোগ শুরু অনিলদের।

সার্কাসে যাঁরা পারফর্ম করেন, তাঁদের আর্টিস্ট বলা হয়। এঁরা অনেকেই পরিবার নিয়ে থাকেন। তাঁবুতেই জীবন। তো এমন বেশ কয়েকটি পরিবারও আটকে পড়েছে। এই পরিবারগুলোতে শিশুও সব মিলিয়ে রয়েছে প্রায় দশটি।
অনিল জানালেন, গত চারদিন ধরে অবস্থা পুরোপুরি শোচনীয়। শুধু ভাত আর আলু সেদ্ধ খেয়ে থাকতে হচ্ছে। আজ সেটাও নেই। মরার ওপর খাড়ার ঘা, আজ সকালে ফুরিয়ে গেছে গ্যাসের সিলিন্ডারও। লঙ্গরখানায় একসঙ্গে রান্না হয়। কোনও কোনও পরিবার অন্য সময় নিজেরাই রান্না করে খায়। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে লঙ্গরখানাতেই রান্না হচ্ছে সবার। আজ সিলিন্ডার শেষ হয়ে যাবার পর রান্নাও বন্ধ। লঙ্গরখানার দায়িত্বে রয়েছেন দুজন ভাণ্ডারি, তাঁরাও হাত তুলে দিয়েছেন। অনিল বললেন, আমাদের আজ পুরোপুরি শাটার ডাউন।

করুণ অবস্থা অবলা প্রাণীগুলোর। গোল্ডেন সার্কাসে রয়েছে চারটি ঘোড়া, ছাগল দুটো আর চারটে কুকুর। ঘোড়া আর ছাগলগুলো ফাঁকা ময়দানে ঘাস খুঁজে বেড়ায়।

মুক্তার আলম অরুণাচলে আটক পড়ে যাওয়ায় টাকা পাঠাতে পারছেন না৷ শো বন্ধ প্রায় তিন সপ্তাহ। ফলে বাজার থেকে রসদ কিনে আনার পয়সা নেই। গত ছ’বছর ধরে সার্কাস পার্টি নিয়ে শিলচর আসছেন, কিন্তু এমন বিপর্যয়ে পড়েননি কখনও।
অনিল বললেন, পুরসভার আমন্ত্রণেই তাঁরা শিলচর এসেছেন। কিন্তু পুরসভার চেয়ারম্যান বা সেক্রেটারি একটা ফোন করেও তাঁদের কোনও খবর নেননি। অনিল পুরসভার নম্বরে ফোন করে তাঁদের অবস্থার কথা জানিয়েছেন, কিন্তু কোনও আমল পাননি। তবে হ্যাঁ,২৪ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার মধুমিতা শর্মা দুয়েকদিন খবর নিয়েছেন। আজ এসে আটকে পড়া দেড়শজনের নামের তালিকাও নিয়ে গেছেন৷ তবে দুপুর অবধি কোনও খবর আসেনি।

একরাশ ক্ষোভ নিয়ে অনিল বললেন, সরকার সব দিক বিবেচনা করেই লকডাউন দিয়েছে, আমাদের কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু পুরসভা বা প্রশাসনের কি উচিত ছিল না, আমরা এই যে এতটা মানুষ প্রায় না খেয়ে আছি, একটা খবর নেওয়া! মানবিকতাও তো আছে৷ না কি তাও নেই! অভিমানে কাঁপে অনিলের কণ্ঠ।

গান্ধীমেলাতেই তাঁবু টাঙিয়ে রয়েছেন সুনীল বিশ্বাসরা। মেলায় মেলায় ঘোরেন তাঁরা। সুনীলের বাড়ি উত্তর দিনাজপুরের দাসপাড়ায়। কলকাতার এম কে এন্টারপ্রাইজের হয়ে মেলায় মেলায় অক্টোপাস, ঘোড়ার দোলনা আর থ্রি ডি শো গোলক নিয়ে ঘোরেন।

মহা আতান্তরে পড়েছেন সুনীল। তবে বাঁচোয়া, দলে মাত্র আঠারোজন। তার চেয়েও বাঁচোয়া, কোনও মহিলা নেই। মালিক থাকেন কলকাতায়, মোটামুটি পয়সাকড়িও পাঠাচ্ছেন।
কিন্তু এ ভাবে কদ্দিন! ফাঁকা মাঠ তাড়া করে বেড়ায়।

Photo Credit: Partha Seal

২. আমাদের ভীষণ কষ্ট গো! জন্মেই মেরে রেখেছেন ঠাকুর৷ বাপ মা ভাই বোন থেকেও কোনও বাড়ি নেই আমাদের। সেই কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াই শুধু পোড়া এই পেটের জন্য। এমন দিন এলো গো, এবার তো না খেয়ে মরতে হবে।
ডুকরে ওঠেন নিশা। নিশা দাস।হ্যাঁ, নিশাকে আপনি দেখেছেন। ওই যে ট্রেনে দু হাতে তালি বাজিয়ে আপনার কাছ থেকে টাকা নেয়। ওই যারা বগিতে উঠলে আপনি হয় জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকেন, না হলে আগেই কয়েন দিয়ে বিদেয় করেন। না হলে আবার না ছুঁয়ে দেন৷ আসলে ঘেন্নাই করেন আপনি। ওদের ছোঁয়া ঘিনঘিন করে ওঠে শরীর। হ্যাঁ,ঠিক ধরেছেন, ওরা বৃহন্নলা। অবমানুষ। যাদের আমরা তাচ্ছিল্য করে হিজড়া বলি।

তো এই নিশাদেরও পেট আছে। খিদে আছে। এবং পেটে খিদের আগুন মেটাতে গতর খাটিয়ে কাজ করতে হয় তাঁদের। লকডাউনে সেই কাজই বন্ধ। নিশার পেটেও লকডাউন।

ঘনিয়ালায় বাড়ি ভাড়া করে থাকেন এই হিজড়ারা। নিশা জানান, এমনিতে তাঁরা বারোজন থাকেন। তবে লকডাউন শুরু হওয়ার আগেই কয়েকজন অন্য জায়গায় চলে গেছেন। ঘনিয়ালায় নিশারা এখন রয়েছেন ছয়জন। নিশার গুরু অজন্তা থাকেন টিভি স্টেশনের পাশে। লকডাউন হওয়ায় বেরোতে পারছেন না, যেতে পারছেন না গুরুর কাছেও।

নিশার বাড়ি বঙ্গাইগাঁও। মা নেই, বাড়িতে আছেন বাবা, ভাই, বোন। বোধ হওয়ার পরই নিশা বুঝে যান, ভগবান তাঁকে শাপগ্রস্ত করে পাঠিয়েছেন৷ নিশা বলেন, আমার তখন কতই বয়স, তবু বুঝতাম, এই বাড়ি আমার জন্য নয়৷ আমার এখানে স্থান নেই। অস্থির অস্থির লাগতো। স্কুলে গেলে আমার পাশে কেউ বসতো না। বন্ধুরা টিটকিরি দিত। কাঁদতাম একা একা৷

এরপরই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন নিশা। ঘুরতে ঘুরতে খবর পান পিংকির। নিশার প্রথম গুরু। পিংকি তখন থাকতেন লামডিং। নিশা সেখানে চলে যান। সেই শুরু। এরপর বহু ঘাটের জল খেয়ে নিশা চলে আসেন শিলচর। দল বেঁধে থাকেন তাঁরা। ট্রেনে ট্রেনে ঘোরেন। বিয়ে শাদির বাড়ি দেখলে ঢুকে পড়েন। বা কোন বাড়িতে সন্তানের জন্ম হয়েছে শুনলে সটান চলে যান। এটাই রোজগার। কোনদিন তিনশো কোনদিন ভাগ্য ভালো থাকলে পাঁচশো। তবে, মূল রোজগার ট্রেনেই। লকডাউনে সেই ট্রেনই বন্ধ। ফলে রোজগার নেই নিশাদের। সমাজে তাঁরা ব্রাত্যজন। ফলে এই বিপর্যয়ে তাঁদের পাশে কেউ দাঁড়াবেন, এই আশাও করেন না নিশা।

জানেন গো, শুধু আলু সেদ্ধ ভাত খেয়ে আছি। জমানো টাকাও তো নেই। বড় কষ্ট গো আমাদের। বলেন নিশা।
তবে নিশার গুরুমা অঞ্জনা সরকার শোনালেন আরেক কথা। কাছাড় কিন্নর সমাজের প্রেসিডেন্ট অঞ্জনা জানান, নিশাদের মতো ট্রেনের হিজড়া নন তাঁরা। তাঁদের মূলত ঢোলের ব্যবসা। অর্থাৎ শুভকাজে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নাচগান চৈত্র মাসে এমনিতেই শুভকাজ হয় না। ফলে রোজগার ডাউন থাকে। এর ওপর এই লকডাউন। হুগলির বাসিন্দা অঞ্জনা একুশ বছর ধরে শিলচরে। কিন্নর সমাজের তিনি গুরুমা। কিন্তু এই সংকট থেকে শিষ্যদের কীভাবে রক্ষা করবেন, বুঝতে পারেন না অঞ্জনা৷
বড় অসহায় লাগে গো। হাহাকার করেন গুরুমা।

৩. একমাসের সন্ন্যাস নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন তাঁরা। সন্ন্যাস, ফলে টাকা পয়সা আনেননি সঙ্গে৷ এই একমাস বাড়ি বাড়ি ঘুরে চড়ক করবেন। গেরস্ত যা চাল আর আনাজ দেবেন, সেটাই সবাই মিলে খাবেন। এই এক মাস একসেদ্ধ ভাতের। এই একমাস নারীশরীর বর্জনের। এই একমাস কঠোর সংযমের। জন্ম ইস্তক এটাই দেখে এসেছেন দীপক দাস। বাপ দাদারাও ভক্ত্যা হতেন এই একমাস। ফাল্গুন গড়ানোর আগেই চড়ক বান তোলে দীপকের। ছাব্বিশ বছরের জীবনে এর ব্যত্যয় ঘটেনি কোনও চৈত্রে। এ বারই প্রথম। করোনার করাল থাবায় ভক্ত্যা দীপকদের কার্যত ত্রিশঙ্কু করে রেখেছে এই চৈত্রে।
বাপ ঠাকুরদার জন্মেও এমন চৈত্র আসেনি। বললেন দীপক। পেশায় দিনমজুর। বাড়ি ইটখলা বাঁধের ওপর।
চৈত্রের তিন তারিখ থেকে ভক্ত্যা নিয়েছেন দীপকরা। প্রায় দশজন। এর মধ্যে তিনটে বাচ্চাও রয়েছে, যারা শিব গৌরী সাজে। রবিবার ছিল জনতা কারফিউ, শনিবারই শেষ দল নিয়ে বেরিয়েছিলেন দীপকরা। তখনই বুঝে যান হাওয়া ভালো নয়৷ কোনও কোনও বাড়িতে ঢুকতেই দেয়নি, যারা দিয়েছে, তারাও মন থেকে দেয়নি, ঠিক বুঝতে পেরেছেন তাঁরা। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন, বাচ্চাগুলোকে তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন৷ ওরা শিশু, ওদের অপরাধ নেবেন না শিবঠাকুর৷ তিনটি বাচ্চাই মালুগ্রাম এলাকার, আর দেরি না করে তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

কিন্তু তাঁরা যাঁরা ভক্ত্যা বা সন্ন্যাস মেনে সংসার ‘ত্যাগ’ করে বেরিয়ে এসেছেন, তাঁরা তো এই একমাস বাড়ি ফিরতে পারবেন না।
নিয়ম হচ্ছে, এই একমাস এক সঙ্গে থাকতে হবে সন্ন্যাসীদের। একসেদ্ধ ভাত রান্না হবে এক হাঁড়িতে। সারা দিন বাড়ি বাড়ি চড়ক করে যে চাল বা আনাজ পান, সেটাই এক হাঁড়িতে সেদ্ধ করে খাওয়া হয়।

দীপক জানান, এবার বাড়ি বাড়ি যেতে পারছেন না, ফলে হাঁড়ি চড়ানোই দায়। ইটখলা স্বামীজি রোডে একমাসের জন্য বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছে। সেখানেই দীপক মিঠন কুটনরা নয়জন থাকছেন। কঠোর নিয়ম, এই একমাসে যদি বাবা মাও মারা যান, তাহলেও বাড়ি যাওয়া যাবে না।

তা হলে চলছে কীভাবে? খাচ্ছেনই বা কী?

দীপক বলেন, ধার কর্জ করে কোনও মতে পেট ভরাচ্ছি। পরে গায়ে গতরে খেটে শোধ করে দেব।
সমস্যা রয়েছে আরও৷ শিব গৌরী কালীকে যে পোশাক পরানো হয়, সেটারও তো খরচ আছে। কীভাবে সামাল দেবেন এই চৈত্রের স্তব্ধ কালবৈশাখী!

জানি না, মাথায় কুলোয় না। বলেন দীপক। তিনি ভক্ত্যা৷ তাঁর অটল বিশ্বাস, শিবঠাকুর ঠিক উতরে দেবেন৷ বলেন, নদীতে যখন নেমেই পড়েছি, পাড়ের নাগাল ঠাকুরই পাইয়ে দেবেন।
সন্ধ্যায় বাঁধের ওপর বসেন ভক্ত্যারা। লকডাউনে স্তব্ধ চরাচর। সংসারী তাঁরা, তবু বাপ ঠাকুরদার পরম্পরা ধরে রাখতে এই চৈত্রে সন্ন্যাসী তাঁরা। বৈশাখ আসতে এখনও দু সপ্তাহ। লকডাউনের অন্ধকার ডিঙিয়ে চোখ পৌঁছায় না কোন আলোকোজ্জ্বল বৈশাখে।

তখন গান ধরেন কোনও ভক্ত্যা।

সপুত্র কলত্র গোত্র সুখে রাখো শিব

রক্ষ মহারাজার আশ্রিত যত জীব।

একে একে সুর মেলান সবাই। লকডাউনের থম ধরা বাতাসে ভেসে বেড়ায় ভক্ত্যার মঙ্গল আর্তি
রক্ষ মহারাজার আশ্রিত যত জীব

Photo Credit: Partha Seal

৪. বাঁদরগুলো অভুক্ত আজ এতটা দিন। লকডাউন প্রায় বারো দিনে পড়ল। লকডাউন, মানে সব বন্ধ। বাজারহাট বন্ধ। দোকানপাট বন্ধ। কিন্তু পেটের ক্ষুধায় কি লকডাউন লাগানো যায়! মানুষ তাই জোগাড়যন্ত্র সেরে রাখছেন ক্ষুধানিবৃত্তির৷ মানুষ, জীবশ্রেষ্ঠ মানুষ আগামীর ব্যবস্থা করে রাখেন। কিন্তু অন্য প্রাণীরা? জঙ্গলের কথা আলাদা, কিন্তু যেসব অবলা জীবের ক্ষুধা নিবারণ কিছুটা হলেও মানুষের ওপর নির্ভরশীল, তাদের অবস্থাটা একবার ভাবুন তো!
শ্রীকোণা বাজারের সামনে বাঁদরদের একটা আস্তানা রয়েছে। এই বাজারেই ঘুরে বেড়ায় ওরা। জুটে যায় কলাটা মুলোটা। লকডাউনের দিন থেকে বাজার বন্ধ। ফলে ভুখা রয়েছে বানরকুল। আগে দিনের বেলা গেরস্তের ঘরে ঢু মেরে কিছু খাবার ছিনিয়ে আনা যেত। এখন সে গুড়ে বালি। বাড়ির পুরুষরা ঘরবন্দি, বাঁদর দেখলেই দে তাড়া। ফলে, আজ বারো দিন অভুক্ত বাঁদরগুলো।
খবরটা শুনে আনচান করে ওঠে পার্থ শীলের মন। পার্থ এ অঞ্চলের বিখ্যাত চিত্র সাংবাদিক। ক্যামেরা নিয়ে খবরের খোঁজে উপত্যকা চষে বেড়ান। শ্রীকোণার বাঁদরকুলের দুর্গতির খবর পেয়ে লকডাউনের মধ্যেই স্কুটার নিয়ে পার্থ চলে যান শ্রীকোণা। দোকান থেকে কিনে নেন প্যাকেট দশেক মারি বিস্কুট। রাস্তায় পেয়ে যান এক দোকানিকে। তাঁরও পেটে টান, ফুলকপির খদ্দের কই। তো সেই ফুলকপিও কিনে নেন পার্থ।
প্রথমে আসে একদল। বাঁদরগুলোকে বিস্কুট বিলিয়ে দেন। গোগ্রাসে খায় ক্ষুধার্ত বাঁদরগুলো। বাতাসে খবর ছড়ায়। হুড়মুড়িয়ে আসে আরেক দল। মুহূর্তে সাবাড় ফুলকপি। আফসোস হয় পার্থ। আহা, না জানি আরও কতটি অভুক্তই রয়ে গেল!

৫. চারদিক থেকে ধেয়ে আসে শুধু মৃত্যুর ব্রেকিং নিউজ৷ অসুস্থতার স্কোরবোর্ড অস্থির করে আমাদের লকডাউন-স্তব্ধ দুঃসহ প্রহরগুলোকে। মানুষ এখন মানুষকেই ভয় পাচ্ছে, দূরত্বই এখন পরম কাম্য। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এমন কালবেলা আর আসেনি। মানুষ মহামারি দেখেছে। যুদ্ধ দেখেছে। নরসংহার দেখেছে। দেখে চলেছে। তবু মানুষ মানুষেরই সংস্পর্শ চেয়েছে, যে-চাওয়াই আসলে সভ্যতা। মানব সভ্যতা। এই প্রথম মানুষ এক মারণবীজের তাণ্ডবে ত্রস্ত যা মনুষ্যত্বের সংজ্ঞা পালটে দিচ্ছে।
এই দুঃসহ সময়ে যখন এক সাংবাদিক লকডাউন সাঁতরে অভুক্ত বাঁদরদের খাবার দিতে ছুটে যান, তখন এই প্রত্যয়ই জন্মায় যে মানুষ এখনও মানুষই।

Comments are closed.