Silchar's Somava Biswas writes from London: "What happened after England won the finals"
-“ম্যাচটা শান্তিতে দেখতে চাও না অশান্তিতে?”
প্রশ্ন করেছিল জয়দীপ। জীবনসঙ্গীর এ হেন প্রশ্নের কারণ ছিল। আমাদের অনেকটা গেছো দাদার মতন অবস্থা। কখন যে কোথায় থাকি তার হিসেব আগে থেকে করা মুশকিল। তাই লন্ডনে থাকা সত্ত্বেও ক্রিকেট বিশ্বকাপের ম্যাচের টিকিট ছ মাস আগে থেকে কেটে রাখতে পারিনি। আর ফাইনাল ম্যাচের আগে যে টিকিট ‘ব্ল্যাকে’ বিক্রি হচ্ছিল সেগুলো কেনাই যেত, তবে সেই অঙ্কের পাউন্ড দিয়ে ইউরোপের কয়েকটি দেশ ঘুরে আসা যায়। এতটা খরচ করে মাঠে গিয়ে খেলা দেখার ছাড়পত্র জোগাড় করলে মনে অশান্তি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। অবশ্য মাঠে না গিয়েও লন্ডনের প্রাণকেন্দ্রে, লর্ডসের মাঠ থেকে মাইল তিনেকের পথ, ট্রাফাল্গার স্কোয়ারে হাজার দশেক ক্রিকেট ভক্তের সঙ্গে দাঁড়িয়ে বড় স্ক্রিনে ম্যাচ উপভোগ করার বিকল্পও রয়েছে। তবে সেখানে টুরিস্টদের ভিড়ও থাকবে। এত ভিড়ে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে ম্যাচ দেখা খুব একটা ‘শান্তি’র হবে না। তাছাড়া, আগের দিন দোহারের অনুষ্ঠান দেখে রাত প্রায় ১২ টায় বাড়ি পৌঁছে এত ক্লান্ত লাগছিল যে জয়দীপের প্রশ্নের উত্তরে জানালাম ম্যাচ শান্তিতেই দেখা যাক। জয়দীপেরও দেখলাম তাই মত। তখন কে জানত ঘণ্টা কয়েকের মধ্যেই যে নাটক, যে রুদ্ধশ্বাস সাস্পেন্স তৈরি হবে ক্রিকেটের মক্কায়, তাতে আর যাই হোক, শান্তিতে ম্যাচ দেখা মাথায় উঠবে আমাদের!
নিউজিল্যান্ডের করা ২৪১ রান তাড়া করতে নেমে শেষ ওভারে জেতার জন্য ইংল্যান্ডের যখন প্রয়োজন ১৫ রানের, তখন কেন কে জানে আর বাড়ি বসে থাকতে পারলাম না। ম্যাচ দেখতে আমরা গেলাম জিমে। ইংল্যান্ড ফাইনাল খেলছে, তাই ব্রিটিশ টভি নেটওয়ার্ক স্কাই বিনামূল্যে ম্যাচ সম্প্রচার করছে। জিমে গিয়ে দুজনে দুটো ক্রস ট্রেইনার এক্সারসাইস বাইকে বসে গেলাম। বেন স্টোকস যখন ট্রেন্ট বোল্টকে ছক্কাটা হাঁকিয়েছেন, উত্তেজনায় আমরা চিৎকার করে উঠেছি। আর আমাদের পাশের ট্রেডমিলে দৌড়নো সাহেব? দিব্যি নির্বিকার চিত্তে কানে হেডফোন গুঁজে দৌড়ে চলেছেন! শেষ বলে যখন জেতার জন্য ইংল্যান্ডের দরকার ২ রান তখন উত্তেজনায় দম বন্ধ হয়ে আসছে। মন বলছে ছুটে চলে যাই ট্রাফাল্গার স্কোয়ারে, উন্মাদনার ঢেউয়ের মধ্যে গিয়ে পড়লে যদি খানিকটা সুস্থির হওয়া যায়! কিন্তু তখন মন্ত্রমুগ্ধের মতো টিভির সামনে আটকে গিয়েছি, চোখের পলক ফেলতেও যেন ভুলে গিয়েছি। তারপরের মাঠের গল্প সবারই জানা। একশো ওভার খেলার পর ম্যাচ টাই হল, সুপার ওভারেও নিষ্পত্তি হল না, ম্যাচে বেশি বাউন্ডারি মারার জন্য বিশ্বকাপ উঠল ইংল্যান্ডের হাতে, আর বাজিগর নিউজিল্যান্ড সবার মন জিতে নিলেও, তাদের হাতে গত বিশ্বকাপের মতোই, রইল সেই পেন্সিল! কত রানে বিশ্বকাপ জিতল ইংল্যান্ড? শূন্য! কত রানে হারল নিউজিল্যান্ড? শূন্য! এমন বিশ্বকাপ ফাইনাল কস্মিনকালে কেউ দেখেনি।
তা যেমনই হোক, প্রথমবার ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ তো পেল ইংল্যান্ড। ক্রিকেটের জন্মস্থানে এ নিয়ে না জানি কেমন উদ্দীপনা, উত্তেজনা শহর জুড়ে! আর তো দেরি করা চলে না। সেন্ট্রাল লন্ডনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম মুহূর্তের মধ্যে। তা সে সিদ্ধান্ত যে কিউয়ি ক্যাপ্টেন উইলিয়ামসনের টস জিতে ব্যাট হাতে নামার সিদ্ধান্তের মতোই দুর্ভাগ্যজনক হবে কে জানত! যা হোক, অ্যাপার্টমেন্ট থেকে দৌড়ে বেরিয়ে টিউবে গিয়ে উঠলাম। আমাদের বাসস্থান থেকে ট্রাফাল্গার স্কোয়ারে পৌঁছতে মিনিট কুড়ি লাগল। টিউবে ব্রিটিশ সহযাত্রীদের দেখলাম কোনো হেলদোল নেই। কেউ মন দিয়ে বই পড়ছেন, কেউ বা হেডফোন কানে বসে আছেন। কেউ আবার ভাবলেশহীন মুখে বসে আছেন। ব্রিটিশরা যে চাপা স্বভাবের তা জানি। তাই বলে এত বড় জয়ের পরও কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে না ওদের মধ্যে! চমকের আরও বাকি ছিল। লেস্টার স্কোয়ারে টিউব থেকে নেমে ন্যাশনাল পোট্রেট গ্যালারির পেছন দিক ধরে হেঁটে ট্রাফাল্গার স্কোয়ারে পৌঁছতে লাগল মিনিট পাঁচেক। সেটুকু পথ পাড়ি দেবার সময় এক জায়গায় খুব ভিড় দেখে মনে হল বাহ, ট্রাফাল্গার স্কোয়ারেও পৌঁছতে হল না, তার আগে থেকেই ক্রিকেট ফ্যানেদের দেখা পেয়ে গেলাম। একটু খোঁজ করতেই ভুল ভাঙল, এই ভিড় হচ্ছে লায়ন কিং সিনেমার প্রিমিয়ারে আসা হলিউড অভিনেতাদের দেখার ভিড়। তারপর আর অপেক্ষা না করে সোজা ট্রাফাল্গার স্কোয়ার,সেখানে পৌঁছে দেখি- পুলিশ, রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা কর্মীরা ব্যানার, ব্যারিকেড গোটাচ্ছেন, জায়ান্ট স্ক্রিন সরানো হচ্ছে, জায়গাটা পরিষ্কার করতে লেগে গেছেন ক’জন কর্মী। ফ্যানরা চলে গেছে, ট্রাফাল্গার স্কোয়ারে নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে ১৮০৫ এর ট্রাফাল্গার যুদ্ধের বিজয়ী বীর এডমিরাল নেলসনের মূর্তি। না দেখলে বিশ্বাস করা অসম্ভব যে আধ ঘণ্টাও হয়নি, এ দেশ ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিতেছে। একজন এশিয় ক্রিকেট ভক্তকে দেখলাম ইংল্যান্ডের পতাকা হাতে ঘুরছেন! আগের দিনই ব্রিটিশ মিডিয়া জানিয়েছিল যে টিম ইংল্যান্ড জিতলেও ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড, আসন্ন অ্যাসেজ সিরিজের কথা মাথায় রেখে জয় উদযাপন করতে ইয়োন মরগ্যানদের দলকে প্যারেড কিম্বা স্ট্রিট পার্টি করতে অনুমতি দেবে না। কাজেই ২০০৫ এর অ্যাসেজ জয়ের উদযাপনের সেই ওপেন বাস রাইডের পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ইংল্যান্ড ক্রিকেটের ফ্যানদের কী হল? তবে কি ট্রাফাল্গার স্কোয়ার থেকে বেরিয়ে অন্য কোথাও সেলিব্রেট করছে ব্রিটিশরা? আশেপাশে যত নামী পাব, রেস্তোরাঁ আছে, সেসবে ঢুঁ মারলাম। উঁহু। সেখানেও তুমুল কোনো উদযাপন নেই। স্বাভাবিক ছন্দে বাজছে গান, হচ্ছে বিয়ার পান, চলছে গল্প গুজব, সারা হচ্ছে ডিনার। মনে পড়ে গেল ২০১১তে ভারতের বিশ্বকাপ জয়ের দিনটি। শিলচরে ছিলাম। সন্ধ্যে থেকে প্রায় সারা রাত আমাদের পাড়ায় বাজি পুড়েছিল। পরদিন রাস্তায় রাস্তায় আবিরের ছড়াছড়ি। অকালেই উদযাপিত হয়েছিল দিওয়ালি, হোলি। শুধু কি শিলচর! সারা দেশে ক্রিকেট ফ্যানেদের চরম উৎসাহ উদ্দীপনা টিভিতে দেখার স্মৃতি যে এখনো টাটকা। যেন সারা দেশটাই ফাইন্যালে খেলেছিল ধোনিদের সঙ্গে, জিতেছে প্রত্যেক দেশবাসী।
হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম পিকাডিলি সার্কাসে। সেখানে যেটুকু ভিড় চোখে পড়ে তা নানা দেশ থেকে আসা পর্যটকদের। অথচ বিশ্বকাপ ফুটবলে গতবছর যখন ফ্রান্স জিতেছিল, তখনও কেমন ঘণ্টার পর ঘণ্টা উত্তেজনায় ফুটছিল এই পিকাডিলি সার্কাস, ট্রাফাল্গার স্কোয়ারের চত্বর। পিকাডিলির পাশেই গ্রীকদের সূর্যের দেবতা হেলিওসের চার ঘোড়ার ব্রোঞ্জের মূর্তিটি কখনো ফাঁকা পাওয়া যায় না। ওটা ঘিরে সবাই ছবি ওঠে, তাই সর্বদা ভিড় লেগেই থাকে। আজ দেখলাম সেই মূর্তির সামনেটাও ফাঁকা। যে উদ্দীপনার, উন্মাদনার উত্তাপ নিতে এসেছিলাম, তা বিফলে গেল। অগত্যা মনের দুঃখে একটা ছবিই উঠলাম হর্সেস অফ হেলিওসের সামনে। জয়দীপ আমার অবস্থা দেখে হাসছিল। বলল, “জানোই তো, এ দেশে ক্রিকেটের চেয়ে ফুটবলের জনপ্রিয়তা বেশি। আর, ভেবে দেখো, আগামীকাল হচ্ছে সোমবার। সবার তো কাজে বেরোতে হবে সকাল সকাল। আজ শনিবার হলে হয়তো ভিক্টরি সেলেব্রেশন আরও কিছুক্ষণ চলত।”
ফেরার পথে বাস ধরলাম। যাতে বাসের জানালা দিয়ে দেখতে পাই শহরটাকে। আট কিলোমিটারের সেই পথটুকুতেও কোনো উদযাপন দেখতে পেলাম না। তখন এখানে প্রায় দশটা। সবে সন্ধ্যার আঁধার নামছে। তাই কেবল রাস্তাতেই নয়, আকাশের দিকেও চোখ রাখলাম। যদি আতশবাজি দেখতে পাই। এ দেশে তো ফায়ারওয়ার্কস খুব জনপ্রিয়! নাহ, সে গুঁড়েও বালি। এদিকে আমার ফোন ক্রমাগত বেজে চলেছে। কল, মেসেজ করে আত্মীয় স্বজন, বন্ধুরা জানতে চাইছে লন্ডনের রাস্তাঘাটে কী হচ্ছে!
ক্রিকেটবিশ্বের ইংল্যান্ডকে নতুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হিসেবে পাওয়ার পর দুদিন কেটে গেছে। ব্রিটিশ টিভি চ্যানেলে, পত্রপত্রিকায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় এখনো আলোচনা হচ্ছে আনবিলিভেবল, অ্যামেজিং, আনফ্যাদমেবল, এক্সট্রাওর্ডিনারি সেই ফাইন্যাল, দ্য গ্রেটেস্ট গেম অফ ক্রিকেট হিস্টরিকে নিয়ে। এ দেশে ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার নিয়ে, স্কুল, কলেজের ছাত্রদের মধ্যে ফুটবল, রাগবি, বেসবলের জায়গায় আবার ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা ফিরে আসার সম্ভাবনা নিয়ে, বেন স্টোকসের স্টিলের নার্ভ নিয়ে, তাঁর জন্মসূত্রে নিউজিল্যান্ডার হওয়া নিয়ে, এই বিজয়ে ইংল্যান্ড দলের অভিবাসী বংশোদ্ভূত খেলোয়াড় ও ব্রেক্সিট-সমর্থকদের অভিবাসনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। লন্ডনের রাস্তাঘাট, অলি গলি, দোকান পাট, ট্রেন, বাসে পথচারী, ক্রেতা কিম্বা যাত্রীদের এ নিয়ে বিশেষ মাথা ব্যথা নেই। তারা ছুটে চলেছেন আপন ছন্দে। ফাইনালে জেতাটা তাদের জন্য যেন জাস্ট পার্ট অফ দ্য গেম!
Comments are closed.