Also read in

Sleepless nights and hungry stomachs: Presiding officer shares his experience.

এবার নির্বাচনের প্রস্তুতি অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। ট্রেনিংয়ে ডাকা হল এক মাস আগে যা এর আগে কোনদিনই করা হয়নি। তাই নির্বাচন কর্মীরা এবার ধরে নিয়েছিলেন ভোট গ্রহণের গুরু দায়িত্ব পালন করে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসতে এবার হয়তো হেনস্থাটা কম হবে।

কিন্তু ন্যাট্রিপে গিয়ে সেই ভুল ভাঙলো। নির্বাচনী সামগ্রী সংগ্রহ করতে যথারীতি অনেকক্ষণ গলদঘর্ম হতে হলো। ভোট সামগ্রী মিলিয়ে নিয়ে কোনমতে খাবার জায়গায় গিয়েই চক্ষু চড়কগাছ। তিন নম্বর ক্যান্টিনে টোকেন দেওয়া হয়েছিল,অপ্রতুল জায়গা, প্রায় ৫০ জনের লাইন। বসার কয়েকটা টেবিল ছিল যা ভাগ্যবান কয়েকজনই বসতে পেরেছিলেন। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কোনোক্রমে একটু খাবার (বেশি খেতে ভয় হলো, পাছে পেটের গন্ডগোল হয়ে যায়) সংগ্রহ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেয়ে নিতে হলো। খাবার জল কিনে খেতে হল।

এবার গাড়ি খোঁজার পালা, সেক্টর অফিসারকে জিজ্ঞেস করে গাড়ির কোনো হদিস পাওয়া গেল না। ঠিক মাথার উপরে রোদ, দুইজন সহকর্মী বুথ বানানোর কার্ডবোর্ড দিয়ে মাথা ঢেকে গাড়ির খোঁজে গেলেন, আমরা জিনিসপত্র নিয়ে গাছের নিচে বসলাম।

প্রায় আধঘন্টা পর গাড়ির অবস্থান জেনে আসলেন ওরা, লটরবহর নিয়ে আমরা রওয়ানা হলাম। আরো দুটো দল আমাদের বাসে যাবে, প্রায় এক ঘন্টা পর ওই দুই দল আসলো। জিজ্ঞেস করে জানলাম, গাড়ি খুঁজতেই মূলত দেরি হয়েছে ওদের।

দুগ্গা দুগ্গা বলে রওনা হলাম। নির্বাচন কেন্দ্রে পৌঁছে প্রথমেই টয়লেটের অবস্থা দেখে নিলাম। স্বচ্ছ ভারতের কল্যাণে টয়লেট মোটামুটি চলনসই, কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায় । ভেতরে জল নেই, দূরে একটা সিনট্যাক্স থেকে জল সংগ্রহ করতে হবে। আগের দিন তো চলে যাবে কিন্তু ভোটের দিন যদি কারো ‘বড়টা’ পেয়ে যায় তাহলেই মুশকিল, ভোটারদের সামনে জল বয়ে নিয়ে গিয়ে টয়লেটে ঢুকতে হবে ‌।

যাই হোক প্রস্তুতি শুরু হল, আর মাত্র ১২ ঘন্টা হাতে আছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ ক্ষণে ক্ষণে বিঘ্নিত হচ্ছে; এবার অবশ্য একটা চার্জার আলো ওরা দিয়েছিলেন। সেটা দিয়ে কাজ চালানো হলো। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা অতিরিক্ত আলো এবং অন্যান্য ব্যবস্থাদির জন্য সহযোগিতা করলেন। খাবার ব্যবস্থা হল স্কুলের ভেতরে ৭০ টাকা প্রতি প্লেট হিসেবে নিরামিষ ভোজন। মিড ডে মিলের কল্যাণে এখন স্কুলগুলোতে রান্নার ব্যবস্থা আছে। রাত্তিরে খেতে বসে বুঝতে পারলাম স্কুলের বাচ্চারা কত কষ্ট করে এই খাবার গলাধঃকরণ করে। যাক, রাত প্রায় ১২ টায় প্রস্তুতি পর্ব শেষ হলো। মশার কয়েল প্রায় সবাই নিয়ে গিয়েছিলাম, চার পাঁচটা একসাথে জ্বালিয়ে দেওয়া হল; ডেস্ক বেঞ্চ জড়ো করে যে যেরকম পারা যায় শুয়ে পড়লাম। কিন্তু দুটো সমান বেঞ্চ ডেস্ক পাওয়া গেল না, সবগুলো উঁচু-নিচু। তাই সারাদিন পরিশ্রমের পরও চোখে ঘুম আসছিল না। প্রায় শেষ রাত্রে সবাই উঠে পড়লাম। তড়িঘড়ি নিত্যকর্ম শেষ হল, বুথও রেডি করে নেওয়া হল।

এবার আমাদেরকে ট্রেনিংয়ের সময়ই সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল, আমরা যেন ইভিএম বা ভিভিপ্যাট মেশিন নির্বাচনের দিন সকালেই চালু করি। তাই মনে ভয়, যদি কোনো গন্ডগোল বেরোয়, তাহলে হেনস্থার এক শেষ। বরাতজোরে আমাদের মেশিন গুলো ঠিকই ছিল। কিন্তু আমাদের পাশের বুথের ইভিএম খারাপ বেরোলো, সেখানে ভোট শুরু করতে করতে সকাল প্রায় সাড়ে আটটা। ওই বুথের নির্বাচন কর্মীদের লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিদের বাক্যবাণে বিদ্ধ হতে হলো।

যাই হোক নির্বাচন ভালোয় ভালোয় শেষ করা গেল। ইভিএম বিকল হওয়ায় ভোট শেষ করে কাগজপত্র তৈরি করতে পাশের বুথের লোকদের অনেক দেরি হল, স্বাভাবিকভাবে আমাদেরও দেরি হল, কারণ একই গাড়িতে আসতে হবে।

যথারীতি মহাসড়ক জুড়ে জ্যাম আর জ্যাম, দু তিন ফুট এগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ড্রাইভার বলল এরকম চললে অনেক দেরি হবে, আপনারা বরঞ্চ নির্বাচন সামগ্রী নিয়ে হেঁটে চলে যান। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম অনেকেই এরকম ভোট সামগ্রী নিজস্ব লটরবহর নিয়ে হেঁটে হেঁটে চলছে। সাহস হলো না কারণ, আমাদের বাসের নির্বাচন কর্মীরা প্রৌঢ়ত্বও পার করতে চলেছেন। রাত প্রায় ১০টায় ন্যাট্রিপের গেটের সামনে আমাদের নামিয়ে দিল ড্রাইভার।

নির্বাচন সামগ্রী সংগ্রহের সময় জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়েছিলাম ওই কাউন্টারেই আবার জমা দিতে হবে। কাউন্টারে তাড়াতাড়ি পৌঁছে দেখি ভিড় অনেক কম, মনে খুব আনন্দ হল; কিন্তু ভুল ভাঙলো। এবারের নতুন হ্যাপা জুড়ে দেওয়া হয়েছে, কাগজপত্র ভেরিফিকেশন করে আনতে হবে অন্য এক কাউন্টার থেকে। লম্বা লাইনে গিয়ে দাঁড়াতে হলো রাত প্রায় ১১টায়। দুইদিন অনাহার-অর্ধাহার বিনিদ্র যাপনের পর ভোট সামগ্রী জমা দিতে এসে চূড়ান্ত হেনস্থা হলো ওইখানেই। সঞ্চিত শক্তি প্রায় শেষ পর্যায়ে, খিদে পেটে চো চো করছে। ভোট নিতে নিতে সারাদিনে দুটো রুটি- সবজি আর দু কাপ লাল চা খেয়েছিলাম। আড়াই ঘন্টা ওই লাইনে দাড়াতে হলো। সবার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছিল ক্ষণে ক্ষণেই। শেষ শক্তি দিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করছেন অনেকেই, কিন্তু ফল শূন্য। যেখানে দশটা কাউন্টারও অপ্রতুল হতো সেখানে তিনটে কাউন্টার দেওয়া হয়েছিল প্রতিটি বিধানসভা কেন্দ্রের জন্য। নির্বাচন কর্মীদের যদি মানুষ মনে করা হতো তাহলে অন্তিম ক্ষণে এই হেনস্থা হতে হতো না। রাত প্রায় দেড় টায় ভেরিফিকেশনের নামে হেনস্থা সম্পন্ন হল। তারপর নির্দিষ্ট কাউন্টারে এসে ভোট সামগ্রী জমা দিলাম। সেখানে অবশ্য পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমার রিলিজ অর্ডার এসে গেল।

সহকর্মীদের নিয়ে গেইটে এসে দেখলাম নির্দিষ্ট গাড়িগুলোতে ওঠার কোন উপায় নেই। ন্যাট্রিপ থেকে শিলচর শহরে আসতে ৬০০ টাকা অটো ভাড়া দিয়ে বাড়ি এসে পৌঁছলাম রাত প্রায় তিন টায়। দেখলাম, অটোর শব্দ শুনে গিন্নি গেটে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার হাত থেকে ব্যাগটা কেড়ে নিয়ে বললেন, গরম জল করা আছে চটপট চান করে আসো।

খেতে যখন বসলাম তখন পাখি ডাকতে শুরু করেছে, খাবার মনে হলো অমৃত। যে রাতে দুটো রুটি খাই, সেই আমি প্রায় এক থালা ভাত খেয়ে নিলাম। গিন্নি সকরুণ চোখে বললেন, সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি।

নির্বাচন যায় আসে, ভোট কর্মীদের দুঃখ কেন কেউ বুঝে না। হুমকি-ধমকি অনেক দেওয়া হয়, কর্তব্যে অবহেলা করলে তা কর্তৃপক্ষ দিতেই পারেন। কিন্তু যারা দায়িত্ব সচেতন ভাবে কর্তব্য সম্পাদন করেন তাদেরকে এত হেনস্থা কেন?

এই নিবন্ধটি একজন প্রিসাইডিং অফিসার লিখেছেন, যিনি তার নাম প্রকাশ করতে ইচ্ছুক নন।

Comments are closed.

error: Content is protected !!