Also read in

Soumitro Shankar Choudhury's memoir on childhood friend Kalika Prasad's death anniversary

The author has written the memoir in Bengali and we do not have a translated version of this story. 

‘শিশুতীর্থে’র প্রসাদ থেকে দোঁহারের কালিকা প্রসাদ

  প্রসাদ নেই এই সত্যটাকে সব সময় এড়িয়ে চলি সুবিধার জন্য । কেউ প্রসাদ নিয়ে কিছু সময় কথা বললে শিশুসুলভ কান্না ভেসে আসে আমার চোখে মুখে অনিচ্ছা সত্বে ও। যিনি উলটো দিকে দাঁড়িয়ে প্রসাদ নিয়ে তাঁর মনের আবেগে দু-একটা কথা শুরু করেছিলেন আমার অবস্থা দেখে অন্য প্রসঙ্গে যেতে বাধ্য হয়ে পড়েন । আজ যখন কথাগুলো লিখছি তখন কোনভাবেই প্রসাদ যে নেই এই বাস্তবকে মেনে নিয়ে কিন্তু লিখছিনা । যাই হোক আমার ব্যক্তিগত সব বোকা বোকা কথা বলে পাঠককে বিরক্ত করতে চাইছিনা, তাই মূল প্রসঙ্গে চলে আসছি ।

ছোট ছোট পায়ে গুটি গুটি হেঁটে সঙ্গীত বিদ্যালয়ের ভবনে ‘অ’,‘আ’ শিখতে গেলাম আমি ও প্রসাদ। শ্রীযুক্তা মঙ্গলা ভট্টাচার্য ও প্রয়াত হিমানী ভৌমিকের হাত ধরে প্রথম পড়াশুনা শিখতে যাওয়া । মঙ্গলা ভট্টাচার্য প্রসাদের পিসি, আমার দিদিমা। তাঁরই উদ্যোগে শিক্ষা ক্লাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হল, নাম দেওয়া হল শিশুতীর্থ। ক্লাস ফোর অবধি পড়াশুনা করে দুজনেই চলে এলাম স্থানীয় নরসিং স্কুলে। মাধ্যমিক অবধি একসাথে চলা। আমি এক বছর সিনিয়র হয়ে গেলাম নরসিং স্কুলে, কারন আমি ক্লাস ফোর না পড়েই সরাসরি ক্লাস ফাইভে  উঠে পড়ি। আমি, মিঠু(কমলেশ ভট্টাচার্য), প্রসাদ ও রাজা – চারজনকে নিয়েই ছিল আমাদের ছেলেবেলা। নরসিং স্কুলে পড়ার সময় প্রসাদের ছাত্র রাজনীতিতে পা। কবি বিজয় কুমার ভট্টাচার্য তাঁর জীবনে তাঁকে বাংলাকে ভালবাসতে শেখালেন। পাশাপাশি প্রয়াত গৌরাঙ্গ সাহার হোমিওপ্যাথি মেডিসিনের দোকানে হা করে বসে থাকা এবং বড়দের আলোচনা গোগ্রাসে গেলা তাঁকে আমদের থেকে বোধগত শিক্ষা দীক্ষায় অনেকটা এগিয়ে নিয়ে গেল। জীবনে দুলাল মিত্র দিয়ে গেলেন খানিকটা দীক্ষা। প্রসাদের জীবনে এলেন পুন্যপ্রিয় চৌধুরি, এলেন শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার। এই দুজন ব্যক্তি প্রসাদের জীবনে না এলে  কি যে হত বলা মুশকিল। তাঁর রাজনৈতিক শিক্ষার বিকাশ,এর সাথে সাংগীতিক বিকাশ, বুদ্ধির বিকাশ সব কিছু ঘটতে লাগল। প্রসাদ এমন এক সাংস্কৃতিক পরিবার থেকে উঠে আসা ছেলে যেখানে ঘুম ভাঙ্গে তাঁর জেঠার গানের রেওয়াজ শুনে, ঘুমোতে যায় পিসির( আনন্দময়ী, যার হাতে লালিত পালিত হয়েছিল প্রসাদ) গানের সুরের আবেশে। বাবা প্রয়াত রামচন্দ্র ভট্টাচার্য এবং মাতা স্বর্গীয়া গীতাঞ্জলি ভট্টাচার্যের পুত্র কালিকা, যার কাকা প্রয়াত অনন্ত কুমার ভট্টাচার্য লোকসংগীতের গবেষক-সংগ্রাহক। আরেক কাকা লোকনৃত্যের গবেষক- সংগ্রাহক স্বর্গীয় মুকুন্দ দাস ভট্টাচার্য। সেই রত্ন ভাণ্ডারে রত্ন জন্মাবে না তো কি হবে । শিলচর সঙ্গীত বিদ্যালয়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে  জড়িত ছিলেন কালিকা। নরসিং স্কুল থেকে গেলেন জি সি কলেজে। দাপিয়ে ছাত্র রাজনীতি করলেন। হয়ে গেলেন কলেজের সাধারন সম্পাদক। অসাধারন নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা ছিল প্রসাদের।

Kalika Prasad and Soumitro Shankar at various stages of life

এবার পাড়ি দিলেন কলকাতায় আরও পাঁচজনের মতো পড়াশুনা করতে। সেখানে গিয়ে তাঁর শৈশবের কৈশোরের সঙ্গীত শিক্ষা, সংঘটন করার অভিজ্ঞতা, নেতৃত্ব  দেবার ক্ষমতার সম্মিলিত নিটফল ‘দোহার’ গানের দলের সৃষ্টি । যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পারেটিভ লিটারেচারে মাস্টার ডিগ্রী করলেন। ছিনিয়ে নিলেন গোল্ড মেডেল । অসম্ভব রকম পড়াশুনা, জ্ঞান অর্জন করার ক্ষমতা এবং আকর্ষণ উত্তরোত্তর প্রসাদ থেকে কালিকা-তে বিকশিত করতে লাগল। চলতে লাগল ‘দোহার’ এর অনুষ্ঠান। গান করেন একজন মানুষ আবার বক্তা দারুণ, জ্ঞানের ভাণ্ডার অপিরিসীম- কলকাতার মানুষকে আশ্চর্য করে দিল। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত বাকি সব শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনি তাঁর জায়গা করে নিলেন। মঞ্চ অনুষ্ঠানে জোর দিলেন। খানিকটা উপেক্ষিত লোক সংগীতকে আড়ম্বরের চাকচিক্যে সুসজ্জিত ড্রাম কি-প্যাডের উচ্চ নিনাদে উপস্থাপিত অন্যান্য সঙ্গীত দলের পাশেই ‘দোহার’ জায়গা করে নিল । ঢাক–খোলের অসাধারন ব্যাবহার ও পরিকল্পিত উপস্থাপন এবং তাঁর দল ‘দোহারে’র অসামান্য পরিবেশন, গায়ন, সাজসজ্জায় মনে হল লোক সংগীত যেন বীর দর্পে আহবান করছে এই যুগের, এই সময়ের যুবা-কিশোরদের যে, ‘এসো রস নিয়ে দেখ আমাতেই মজে যাবে তুমি’। তাই-ই হল; যুবক থেকে কিশোর, বৃদ্ধ  থেকে জওয়ান প্রত্যেকে শরীর দোলাতে লাগলেন ‘দোহারে’র লোকসংগীতের মঞ্চ উপস্থাপনায়। করিমগঞ্জের রাজীব ছিলেন কালিকার সেনাপতি, যাকে ছাড়া কালিকার এই সাংস্কৃতিক যুদ্ধে জয়ী হওয়াটা হয়তো আরো মুশকিল হত । সঙ্গ দিলেন করিমগঞ্জের আরো দুই সৈনিক বাবলু ও উত্তম। আমার এই সময়টায় দোহারের সাথে চুটিয়ে নাচ করে যাবার সুযোগ হয়েছিল। দোহারের এই বড় হওয়ার সময়টায় আমিও দু-একবার ঢাল-তলোয়ার হাতে নিয়েছিলাম। তারপর আরো কত ঘটনা যা অনেকেরই জানা তাই পুনরাবৃত্তি করছিনা ।

মঞ্চ অনুষ্ঠানের পাশাপাশি এবার হাত দিলেন লোকসংগীতের গবেষণায়। লোকশিল্পীদের সান্নিধ্য নিলেন। পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে ঘুরে লোকসংগীত সংগ্রহে মনোনিবেশ করলেন। কাকা অনন্ত কুমার ভট্টাচার্যের লোকসংগীতের দল ‘লোকবিচিত্রা’য় ‘ডবকি’ বাজাত কালিকা; সেই লোকবিচিত্রার শিক্ষায়, অনন্ত ভট্টাচার্যের স্পর্শে, তাঁর অর্ধ সমাপ্ত কাজ সম্পূর্ণ রূপ পেতে লাগল কালিকাদের দোহারে। দোহারের যাত্রাপথ দুরন্ত গতিতে এগোতে লাগল। রাজীব, সৌম্য, মৃগনাভি, অমিত, ছোটু  নিরঞ্জনদাদার সম্মিলিত শক্তি ও কালিকার নেতৃত্ব লোকসংগীতকে দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশের মাটিতে, দেশীয় বানিজ্যিক চ্যানেলে, যুবক-কিশোরের মনে সাংঘাতিক রকম জায়গা করে নিল। ঠিক এই সময়ে হঠাৎ করে বিধাতা… ।

এখানেই ইতি টানলাম । পাঠকদের মনে হতে পারে কেমন যেন তাল কেটে গেল লেখায়, আসলে এমনটাই ছন্দপতন হয়েছে ‘দোহার’ এবং কালিকার, হঠাৎ ।

লেখক – সৌমিত্র শঙ্কর চৌধুরী, নৃত্য শিল্পী   (কালিকার শিশুবেলার বন্ধু )

 

Comments are closed.