
Spending ten years in detention camp without any fault, Shahanara Says "I like freedom, wants to be a doctor"
করোনা ভাইরাস গতবছর অনেকের প্রিয় জনকে কেড়ে নিয়েছে, সারাবিশ্বের ক্ষতি হয়েছে, তবে ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি থাকা অনেকে এই পরিস্থিতির জন্যই মুক্তির স্বাদ পেয়েছেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, উধারবন্দের লাঠিগ্রামের দশবছরের শাহানারা। যদিও বিদেশি সন্দেহে জেল খাটেনি সে, তার মায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল। যখন পুলিশ মাকে নিয়ে যায়, শাহানারার বয়স প্রায় ছয় মাস। আধিকারিকদের অনুমতি নিয়ে তাকে সঙ্গে নেন মা মিনারা বেগম। কোকরাঝাড় এবং গোয়ালপাড়া জেলে তার জীবনের প্রথম নয় বছর কেটেছে। প্রায় একবছর শিলচর সেন্ট্রাল জেলের ডিটেনশন সেন্টারে কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছে। যখন বুঝতে শিখেছিল, সে জেলে রয়েছে এবং অভিযোগ তার মায়ের বিরুদ্ধে, তার বিরুদ্ধে নয়, খুব রাগ হলে মা-কে দোষারোপ করত, ‘কেন আমাকে জেলে নিয়ে এলে।’ তবে মায়ের মনে মনে উত্তর ছিল, ‘আর কেউ তোকে রাখতে চায়নি, নাহলে মা হয়ে তোকে জেলে নিয়ে আসতাম না।’
গতবছর লকডাউন পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ছিল, যারা দুই বছর বা তার থেকে বেশি দিন ধরে ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক রয়েছেন তাদের জামিনে মুক্তি দিতে। তার জন্য কিছু শর্ত ছিল, যেটা পূরণ করতে বিভিন্ন সমাজসেবী সংগঠন থেকে শুরু করে পুলিশের আধিকারিকরাও সাধারণ মানুষকে সাহায্য করেছেন। গরীব-দুস্থ পরিবারের মহিলা-পুরুষ-শিশু মুক্তি পেয়ে বাড়ি ফিরেছেন। তবে সেখানে তাদের পিছু ছাড়েনি বিদেশি তকমা। সপ্তাহে একদিন স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে হাজিরা দিতে হয়।
১১ বছরের শাহানারা বেগম এখন লাঠিগ্রামে এক সরকারি স্কুলে পড়াশোনা করছে। তার স্বপ্ন অনেক পড়াশুনা করবে, সুযোগ পেলে ডাক্তার হবে অথবা কোনও বড় আধিকারিক। তবে পুলিশ নয়, পুলিশ হলে নিরীহ মানুষকে কষ্ট দিতে হয়, এটাই মনে করে সে। বাড়ি ফিরে কেমন লাগছে? এই প্রশ্নের উত্তরে সে বলে, “স্বাধীনতা ভালো লাগে, এখন স্কুলে গেলে কেউ বলে না আমি ‘জেলের বাচ্চা’। আগেও স্কুলে গিয়েছি, সেখানে পুলিশ দিদি আমাদের নিয়ে যেতেন এবং তার সঙ্গেই ফিরতাম, ভেতরে অনেকে ব্যঙ্গ করত জেল থেকে এসেছি বলে। যদিও এতে রাগ হতো না, কারণ আমি তো জেল থেকেই যেতাম। এখন বাড়ি থেকে নিজের মতো করে স্কুলে যাই, অনেকেই বন্ধু হতে চাইছে, নতুন দু’চারটে বান্ধবীও জুটেছে। এখন ইচ্ছে হলেই খেতে পারি, জেলে সকাল দুপুর এবং বিকেলে খাবার দেওয়া হতো, সেটাই নিয়ম ছিল। একই খাওয়ার প্রায় রোজ, আর খেতে ভাল লাগত না। এখন নতুন নতুন খাবার খেতে শিখছি, এখন আমার প্রিয় খাদ্য হচ্ছে মাংস, আগে কোনদিন মাংস খাইনি। রুই আর ভেটকি ছাড়াও অন্য মাছ হয়, সেটা জানতাম না। পড়াশোনা ভালো লাগে, অনেক পড়াশোনা করতে চাই।”
তার কথায় একটা অসমিয়া ভাষার ছাপ রয়েছে, অনেক সাধারণ শব্দ অসমিয়ায় বলছে শাহানারা। কারন প্রথমে সে অসমিয়া ভাষা শিখেছে। গোয়ালপাড়া আর কোকরাঝাড় জেলা থেকে শুরু করে যে স্কুলে পড়তো, প্রত্যেকেই অসমিয়া বলে। ২০১৯ সালের জুন মাসে তাদের শিলচর পাঠানো হয়, সেটাও তার মা মিনারা বেগমের আবেদনের ফলে। এরপর ধীরে ধীরে বাংলা শিখেছে শাহানারা, এখানেই তার দিদিদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। যখন ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছে তার একটা পরিবার রয়েছে, বাড়ি ফেরার জন্য মন ছটফট করত। তখন রাগের মাথায় মাকে বলত, ‘কেন আমাকে এখানে রেখেছো।’
মিনারা বেগমের চার মেয়ের বিয়ে হয়েছে, তিনি জেলে থাকতেই দুজনের বিয়ে হয়েছে। অনেক কঠিন পরিস্থিতি দেখেছেন তিনি। জেলের ভিতর প্রথমে অসমিয়া ভাষা না জানায় নিজের কথা বোঝাতে পারতেন না, শেষমেষ ভাষা শিখেছেন। কয়েদিদের জন্য বরাদ্দ খবারটুকু পেলেও সেটা তার নির্দোষ মেয়ের জন্য পর্যাপ্ত ছিলনা, ধীরে ধীরে সেখানে কাজ করতে শুরু করলেন, যত বেশি পরিশ্রম করতেন তার মেয়ের কিছুটা বাড়তি সুবিধা জুটত। পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে তার মন শক্ত হয়েছে। প্রত্যেকেই তার ছোট্ট মেয়েকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। তার জন্য লেকটোজেন-হরলিক্স-ফল ইত্যাদি আসতে শুরু করেছে। পড়াশোনার ক্ষেত্রে অনেকেই ছোট্ট শাহানারার পাশে ছিলেন। যেদিন জেল থেকে বেরিয়ে আসছেন, প্রত্যেকে বলেছেন ওকে পড়াশোনা করাবে, বিয়ে দেবে না। মিনারা বেগম নিজেও চান তার মেয়ে পড়াশোনা করুক, তবে লাঠিগ্রামে রেখে তার পড়াশোনা কতটুকু হবে সেটা নিয়ে চিন্তিত মিনারা বেগম। তিনি চান মেয়েকে প্রয়োজনে কোনও ভালো হোস্টেলে পাঠিয়ে পড়াশোনা করাবেন, তার স্বপ্ন পূরণ করাবেন। তার একটাই কথা, “আল্লাহ যেন কোন শত্রুকেও এই পরিস্থিতিতে না ফেলেন।” তিনি মাথা উঁচু করে বাঁচতে চান, বলেন, “আমি কোনও অপরাধ করে জেলে যাইনি, কঠিন পরিস্থিতিতে ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে একা সামাল দিয়েছি। তার জীবনে সাফল্য এনে দিতে আরও পরিশ্রম করতে রাজি আছি। আমি মাথা নিচু করে বাঁচবো না, আর মেয়েকেও কারও কাছে মাথা নত করতে দেব না।’
Comments are closed.