The history of theatre: Shekhar Deb Roy
শিলচরের নাট্যচর্চা: আমাদের অবস্থান
বরাক উপত্যকার প্রাণকেন্দ্র শিলচর শহরে নাট্যচর্চার অতীত ইতিহাস সুদীর্ঘ শতবর্ষ অতিক্রান্ত। শিলচরের নাট্যচর্চা শতবর্ষের ঐতিহ্য বিষয়ে বর্ণনা করতে গিয়ে বিশিষ্ট গবেষক ডঃ অমলেন্দু ভট্টাচার্য উল্লেখ করেছেন-
” ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বরাক উপত্যকা ব্রিটিশ কর্তৃক অধিগৃহীত হয়। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে শিলচর শহরের গোড়াপত্তনের মাধ্যমে সূচিত হয় নগরায়ন প্রক্রিয়া। গড়ে উঠতে থাকে অফিস- কাছারি। সময়ের দাবি মেনে ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত হয় স্টেশন কমিটি। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হলে ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে বিধু ভূষণ রায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় প্রথম সংবাদপত্র “পাক্ষিক শিলচর”।
১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে শিলচর পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয় রেল যোগাযোগ।
এ হেন এক জনপদে প্রথম আধুনিকতার নান্দী পাঠ করেছিলেন কবি রাম কুমার নন্দী মজুমদার ( ১৮৩১ – ১৯০৪)। কিন্তু সন্ধিক্ষণের দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে তিনিও মুক্ত ছিলেন না। তাই একদিকে মাইকেল মধুসূদন দত্তের “বীরাঙ্গনা” কাব্যের উত্তর “বীরাঙ্গনা পত্রোত্তর” ( ১৮৭২) রচনা করলেও অন্যদিকে তিনি নিমগ্ন ছিলেন যাত্রাপালা পাঁচালী ইত্যাদি রচনায়। এক্ষেত্রে পরিবেশের দাবিও ছিল প্রবল। বিনোদন মাধ্যম হিসেবে শিলচরে তখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিল কবিগান, পাঁচালী ও যাত্রা গান। এই পরিস্থিতিতে সরকারি কাজের দায়িত্ব নিয়ে ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে শিলচরে এলেন ‘নীলদর্পণ’ খ্যাত নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র। বঙ্গ সংস্কৃতির এই প্রত্যন্ত ভূমিতে এসে তিনি শুধু কাজের পরিমণ্ডলেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলেন না। স্থানীয় ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিষয়ে তথ্য সংগ্রহে ব্রতী হলেন। কলকাতায় ফিরে গিয়ে লিখলেন “কমলে কামিনী” (১৮৭৩) নাটক। উনিশ শতকের বাংলা নাটকে জায়গা করে নিল বরাক উপত্যকার ইতিহাস।”
অতএব অনুমান করতে বাধা নেই, শিলচরে এসে দীনবন্ধু মিত্র পরিচিত হয়েছিলেন রাম কুমার নন্দী মজুমদারের সঙ্গে। আলাপচারিতার সূত্রে তিনি বপন করে গিয়েছিলেন আধুনিক নাট্যচিন্তার বীজ। কিন্তু প্রান্তীয় এই জনপদের মানসিকতা তখনও আধুনিক নাট্যরীতি গ্রহণে প্রস্তুত ছিল না। দর্শকদের মধ্যেও কোনও চাহিদা তৈরি হয়নি। তাই আধুনিক নাটকের জন্য অপেক্ষা করতে হলো আরও তিনটি দশক।
আধুনিক শিক্ষা প্রসারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে প্রচলিত মূল্যবোধ পাল্টাতে শুরু করল। রুচিবোধও পরিবর্তিত হল। উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য যারা সিলেট, কলকাতা যাওয়া-আসা শুরু করেছিলেন এবং কর্মসূত্রে যারা বাইরে থেকে শিলচরে এসেছিলেন, তারাই নিয়ে এলেন নাগরিক সংস্কৃতির হাওয়া। লৌকিক বিনোদন মাধ্যম পৃষ্ঠপোষকতা বঞ্চিত হয়ে পিছু হটতে শুরু করলে এই নব্য নাগরিকরাই থিয়েটার অভিনয়ে উদ্যোগী হলেন। শিলচরের নাট্যচর্চার সূচনা পর্ব ১৯০৪ – ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ। নতুন আঙ্গিকে পরিবেশিত এই নাটক দর্শকদের মধ্যে ঔৎসুক্য জাগিয়ে তুলল। বাড়তে লাগল নাটক দেখার আকাঙ্খা। সদ্য জাগ্রত এই চাহিদার জোগান দিতে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে শিলচরে এল কলকাতার একটি ভ্রাম্যমাণ থিয়েটার দল “গোল্ডেন জুবিলি থিয়েটার”।
( ১৯১১-১৯৪৭) শিলচরে প্রথম স্থায়ী প্রেক্ষাগৃহ আর ডি আই হল (রিডিং অ্যান্ড ড্রামাটিক ইনস্টিটিউশন হল) স্থাপন করা হয়। এরপর থেকেই নাট্যকর্মীরা নাটক নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অভিনবত্ব সন্ধানে উদ্যোগী হলেন। তবে আর ডি আই হলের নাট্যচর্চা সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য সংরক্ষিত না থাকায় শিলচরের নাট্যচর্চার একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেল!
পরবর্তীতে এই মঞ্চের সুবাদেই শহর শিলচরের নাট্যচর্চার গোড়াপত্তন শুরু হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রাম অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের দামামার (১৯৪২) ধ্বনি এই প্রান্তিক শহরের সাংস্কৃতিক জীবনেও পড়ে। ফলস্বরূপ গোটা শহরের উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো সেনা ছাউনিতে পরিণত হয়। স্বভাবত নাগরিক জীবন জীবিকায় ছন্দপতন ঘটে। যার ফলে নাট্যচর্চায়ও ভাটার টান পড়ে…..।
তবে সেই সময় লক্ষ্য করার বিষয় হল- স্বাধীনোত্তর কাল থেকে শহর শিলচরে বিশেষত সার্বজনীন দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে নাট্যচর্চা পুনরায় শুরু হয়। যেমন আর্য্যপট্টি দুর্গাবাড়ি, অম্বিকাপুর (চৌরঙ্গী), রামকৃষ্ণ মিশন রোড, দক্ষিণ বিলপার, ইটখোলা, মধ্য শহর ইত্যাদি স্থানে বেশ আড়ম্বরের সঙ্গেই নাটক মঞ্চায়নে পুনরায় নাট্যচর্চার চাহিদা যেন নব জন্ম লাভ করে …..। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাটক হল- কেদার রায়, শাজাহান, বঙ্গে বর্গী, চক্রধারি, স্বর্ণলঙ্কা, উত্তরা, বিসর্জন, উল্কা, রক্তকরবী গয়াতীর্থ ইত্যাদি। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে এপ্রিল মাসে শিলচরে অনুষ্ঠিত হয় গণনাট্য সংঘের প্রাদেশিক সম্মেলন। বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে বামপন্থী ভাবধারার প্রভাব অনস্বীকার্য। নবনাট্য আন্দোলনের মূলেও আছে এই চেতনা। শিলচরের নাট্যচর্চায়ও বামপন্থী চিন্তার সুফল দেখা গেল। সেই সম্মেলনে অচিন্ত্য ভট্টাচার্য রচিত ‘আদাব’ নাটকটি মঞ্চস্থ করা হয়। সম্ভবত তখন থেকেই বামপন্থী প্রগতিশীল ধারায় সূচনা হলো নতুন আঙ্গিকের নাট্যাভিনয়।
গণনাট্য সংঘ ছাড়া ষাটের দশকের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের মত শিলচরেও গ্রুপ থিয়েটার আদলে বেশ কয়েকটি নাট্যদল সৃষ্টি হয় যাদের হাত ধরেই শিলচরের নাট্যচর্চায় আসে নতুন জোয়ার। রুপম (১৯৬১), নাটুকেরা (১৯৭০), পুবালি (১৯৭২), গণসুর (১৯৭২), শিলচর কালচারাল ইউনিট, দশরূপক (১৯৭৯), দিশারি (১৯৮০), ভাবীকাল (১৯৮৪), কোরাস (১৯৮৭), নাট্যাঙ্গন,অগ্রণী, নবারুণ, প্রয়াস,সারস্বত ইত্যাদি। এই পর্বে মুসলমান সমাজও নাট্যাভিনয়ে এগিয়ে আসেন। ১৯৬৬-১৯৬৯ সনে মধুরবন্দের ‘প্রগতি সংঘ’ ‘টিপু সুলতান’ ‘সিরাজদ্দৌল্লা’ ইত্যাদি নাটক মঞ্চস্থ করে। এর মধ্যে ১৯৬৮ সালে জনাব কুতুব আহমেদ মজুমদার রচিত ‘অন্তরাল’ নাটক উক্ত এলাকায় অভিনীত হয়। গ্রুপ থিয়েটার চর্চায় প্রারম্ভে বেশিরভাগ সময়ে বহির্বরাকের ছাপানো নাটক প্রযোজনা করা হত। এর কারণ হয়তো স্থানীয় নাট্যকারের অভাব। যাইহোক এই অভাব বোধ থেকে ধীরে ধীরে আশির দশকের মাঝামাঝি উক্ত নাট্য সংস্থার তাদের নিজস্ব নাটক করার (আঞ্চলিক ও শুদ্ধ ভাষা) আন্তরিক আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। যার ফলে দেখা যায় দশরূপক, কালচারাল ইউনিট, দিশারী, অগ্রণী, নাট্যাঙ্গন, কোরাস, নবারুণ, প্রয়াস এসব নাট্য সংস্থা নিজস্ব নাট্যকারদের নাটকগুলো নানান প্রতিকূল অবস্থা থাকা সত্বেও একের পর এক মঞ্চস্থ করেছে। নাট্যকারদের মধ্যে প্রয়াত যীশু চন্দ, সুজয় ভট্টাচার্য, চিত্রভানু ভৌমিক, শেখর দেবরায়, বিশ্বজিৎ দাস, ইন্দ্রনীল দে, দেবব্রত (চঞ্চু) চৌধুরী, দিপেন্দু দাস, বিশ্বজিৎ চৌধুরি, শেখর দাস এবং কল্যাণী চৌধুরী, চম্পা ভট্টাচার্য, মৌটুসী বিশ্বাস পুরকায়স্থ উল্লেখযোগ্য। ইতিমধ্যে বিভিন্ন নাট্য প্রতিযোগিতা ও নাট্যোৎসবে বহির্বরাকের নাট্যদলগুলোর সাথে আমাদের এই শিলচরের বেশ কয়েকজন নাট্যকার তাদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ রেখেছেন। তবে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা উচিত বলে আমি মনে করি। বিশেষত বর্তমান বাংলা নাটকের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় পরিশীলিত নতুন নতুন নাটক প্রযোজনাগুলোর সাথে আমাদের নাট্যপ্রয়োগগত গুণমান আরও উৎকৃষ্ট করা খুবই প্রয়োজন। সে জন্য এই উপত্যকার নাট্যকারদের আরও বেশি উদ্ভাবনী শক্তি নিয়ে মৌলিক নাট্য রচনার প্রচেষ্টা নিতেই হবে…..। এই উপত্যকার নানা বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক জীবন ধারার সাথে সম্যক জ্ঞান-অভিজ্ঞতা নাট্যরসদ সংগ্রহ করতে হবে। শুধু শহর কেন্দ্রিক নাট্য রচনায় প্রকৃত অর্থে একমাত্রিক প্রকাশভঙ্গি যথেষ্ট নয়। বরাক উপত্যকার আলো হাওয়া রৌদ্রের মাঝেই খুঁজতে হবে আমাদের নাট্য ভাষার স্বার্থে নাট্য আঙ্গিক। নাট্য রচনার স্বার্থে বরাক উপত্যকায় ছোটগল্প থেকে নাট্যরূপ দেওয়ার প্রয়াস ও প্রচেষ্টা নেওয়া যেতে পারে। সেই সাথে নাট্য বিষয়ে আলোচনা সভার মাধ্যমে আমাদের নাট্য রচনায় ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরা উচিত। মতামত বিনিময়ের মাধ্যমে আমাদের নাট্য রচনায় দিশা নির্ণয় করা একান্ত আবশ্যক। বাংলা নাটকের গতি প্রকৃতির সাথে সম্যক জ্ঞান চর্চার মধ্যে দিয়ে বর্তমানে নাট্যকারদের আরও সমৃদ্ধ হতে হবে। নাট্যসংস্থাগুলোর আর্থিক অসচ্ছলতা তদুপরি আধুনিক নাট্যমঞ্চের অভাব অভিযোগ নিয়ে একেবারে খাঁটি অপেশাদারি অবস্থান থেকে নাট্য চর্চা অব্যাহত রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। তবুও আমরা নাটক করি কারণ নাটক ছাড়া আমরা বাঁচবো না।
বরাকের বাইরে থেকে কোনও বিশেষ নাট্য ব্যক্তিত্ব পেশাদারী মানসিকতা ছেড়ে আমাদের এতদঞ্চলের নাট্যচর্চার অহল্যা উদ্ধার করবেন এই আশা করা মনে হয় সঠিক হবে না। অতএব নিজেই নিজের পথ চলার রাস্তা তৈরি করতে হয়। চাই শুধু প্রত্যয়ী মনোভাব।
শহিদের রক্তস্নাত এই বরাক উপত্যকায় যেখানে মাতৃ ভাষা শিখতে হয় রক্তের অক্ষরে, তবুও এত কৃচ্ছসাধনের মধ্যে বুক ভরা আত্মবিশ্বাসের ওপর ভর করে আমরা যে এই উপত্যকার নাট্যচর্চাকে আরও আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই…….।
অবিরত প্রয়াস ও প্রচেষ্টার মাধ্যমেই উপলব্ধি করা যায়- মাথার উপর খোলা আকাশ আর পায়ের নিচে আছে শক্ত মাটি।
কৃতজ্ঞতা-
শিলচরের নাট্যচর্চা: শতবর্ষের ঐতিহ্য।
ড: অমলেন্দু ভট্টাচার্য
Comments are closed.