The story of an Official on election duty; a painful and risky journey
কর্তৃপক্ষ আগেই ঘোষণা করেছিলেন ঢাল তলোয়ারহীন একজন নিধিরাম সাথী হতে চলেছেন ভোট কর্মীদের । সেরকম মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে সাতসকালে আই এস বি টি তে হাজির হয়ে গন্তব্য স্থলের নাম জানার পরেই পেলাম বিষাদ সংবাদ। আমাদের প্রথম পোলিং অফিসার যাকে দেওয়া হয়েছিল তিনি অনেক কষ্টে হাজির হয়েছেন অসুস্থ অবস্থায়, চাকুরিটা তো বজায় রাখতে হবে। উনি আগামী জানুয়ারিতে চাকুরি থেকে অবসর নিচ্ছেন, তাও তাকে রেহাই দেওয়া হয়নি। অসুস্থতার কথা জানিয়ে আগেই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাতে কর্ণপাত করেননি। কিন্তু এই অসুস্থ রোগীকে নিয়ে কি করে এই গুরুদায়িত্ব পালন সম্ভব, তাই হাজির হতে হলো পার্সোনাল সেলে । প্রায় আধ ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ওই সেলের দায়িত্বে থাকা ভদ্রমহিলাকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলার পর তিনি আমার নিযুক্তি পত্রে নতুন একজন ফার্স্ট পোলিং অফিসার দেওয়ার জন্য লিখে দিলেন। ধন্যবাদ জানিয়ে যথাস্থানে হাজির হলাম। সারিবদ্ধ হয়ে রিজার্ভ বেঞ্চে বসে আছেন প্রিসাইডিং, ফার্স্ট পোলিং, সেকেন্ড পোলিং এরকম- কখন ডাক আসে (কিছু মনে করবেন না ওদের দেখে ‘বলির পাঠা’ প্রবাদটা মনে আসছিল)!
সেখান থেকে ভাগ্যক্রমে একজন যুবককে সঙ্গী পেয়ে গেলাম ফার্স্ট পোলিং অফিসার হিসেবে। নির্বাচনের সামগ্রী গুলো সংগ্রহ করে সেগুলো মেলানোর চেষ্টা করলাম। পুরোপুরি মেলানো কোনদিনই সম্ভব নয় এই ভিড়ে ঠাসা আইএসবিটি/ আইএস টিটি চত্বরে। চতুর্দিকে নোংরা ছড়ানো মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে টয়লেটের দুর্গন্ধযুক্ত জল। তাই জরুরি জিনিসগুলো একটু দেখে নিয়ে গাড়ির নাম্বার সংগ্রহ করে গাড়িতে উঠে বসলাম। একটা ক্রুজার দেওয়া হয়েছে দুটো পোলিং পার্টির জন্য। সব মিলিয়ে প্রায় ১৩ জন লোক, সাথে আছে প্রত্যেকের নিজস্ব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, বিছানা শীতবস্ত্র । আর আছে নির্বাচনের সেই দুটো ঢাউস ব্যালটবক্স সহ বিভিন্ন লট বহর। এত জন লোক, সাথে এতগুলো জিনিস এই ক্রুজারের ভিতর ঠেসে ঢোকানো সেটা চাট্টিখানি কথা নয়। আমাদের তো তাও ভালো, অনেককে ডিজেল অটোতে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে পুরো লট বহর শুদ্ধ।
যাক, জাতীয় কর্তব্য বলে কথা! গন্তব্যস্থলের দিকে রওয়ানা না হলেই নয়, কারণ বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। ড্রাইভারকে তাড়া দিয়ে তড়িঘড়ি প্রায় দেড় ঘণ্টার সফরে নির্দিষ্ট পাঠশালা গৃহে এসে পৌঁছলাম । আমাদের বলা হয়েছিল স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা বা কোন প্রতিনিধি আমাদেরকে সব কিছু ব্যবস্থা করে দেবেন। কিন্তু বাস্তবে একজন শিক্ষিকা আমাদেরকে তালাচাবি সমঝে দিয়ে সরে গেলেন। স্বচ্ছ ভারত কর্মসূচির ফলে শৌচালয় গুলো মোটামুটি সবগুলো স্কুলেই এখন চলনসই, তবে জলের একটু সমস্যা আছে। দূরে একটা টিউবওয়েল থেকে জল আনতে হবে, সেটা খুব একটা বড় সমস্যা নয়। আসল সমস্যা হল, পাঠশালা গৃহে বিদ্যুতের কোনও ব্যবস্থা নেই। আর, সারাটা রাত জেগে কাজ করতে হবে সাথে যে মোমবাতি দেওয়া হয়েছে তাতে দু’ঘণ্টাও চলবে না, মোমবাতির আলোয় এত সব কাজ করাও সম্ভব নয়। তাই বিকল্প ব্যবস্থার অনুসন্ধান করতে হলো, আশেপাশে জিজ্ঞাসাবাদ করে বোঝা গেল আইনি পথে বিদ্যুৎ পাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই একজন ইলেকট্রিশিয়ান ডেকে তার, বাল্ব, হোল্ডার এগুলো কিনে দিয়ে রাস্তার পাশের বৈদ্যুতিক সংযোগ ব্যবস্থা থেকে জ্ঞানত বেআইনিভাবে একটা হুক লাইন টেনে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে হলো। তাও টিমটিম করে জ্বলছে, ভোল্টেজ এর অবস্থা খুবই খারাপ, সেটা দিয়েই কাজ চালাতে হবে। ভোটারের সংখ্যা প্রায় বারোশ, চার ধরনের ভোট নিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার ব্যালট পেপার, অন্ততপক্ষে ৬০% ব্যালটের পেছনে পুরো নাম সই করে পরের দিনের জন্য প্রস্তুত করে রাখতে হবে। প্রত্যেকটা ব্যালট পেপারের পেছনে পুরো নামটা সহি হিসেবে দেওয়া যে কতটুকু কষ্টসাধ্য তা বলার অপেক্ষা রাখে না, আর নামটা যদি একটু বড়সড় হয় তাহলে তো আর কথাই নেই। যাই হোক, রাত দুটো পর্যন্ত কসরত করে, বাকি সবার সহযোগিতায় বিভিন্ন ধরনের কাগজপত্র তৈরি করে সই সাবুদ করে রাখা গেল। টিলার উপরে উঁচু জায়গায় অবস্থিত ভোটকেন্দ্রে রাত বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে ঠান্ডাও বাড়ছিল, দরজার উপরে অনেকগুলো ফাঁক থাকায় হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছিল, আর বাইরে কুয়াশা বৃষ্টির মত ঝরছিল । গায়ে থাকা শীত বস্ত্রগুলো খোলার সাহস হলো না, সেগুলো গায়ে চাপিয়েই পাতলা একটা কম্বল ( নির্বাচনী সামগ্রী গুলো সামলে নিজের জন্য ভারি জিনিস নেওয়া যাওয়া সম্ভব নয়) গায়ে দিয়ে দুটো বেঞ্চ জুড়ে দিয়েকোনমতে শুয়ে পড়লাম।
ভোর চারটায় ( বলা ভালো শেষ রাত্র) উঠে পড়তে হলো, না হলে ঠিক সাতটায় ভোট প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব হবে না। কোনোক্রমে প্রাকৃতিক ক্রিয়া কর্ম সেরে, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী পোলিং বুথ তৈরি করে নেওয়া হলো, যদিও প্রকৃতপক্ষে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়- শুধু কাগজপত্রেই সম্ভব।
সকাল ছয়টা থেকে বাগান অঞ্চলের ভোটাররা এসে দরজায় দাঁড়িয়ে গেলেন। ভোটদানে ওদের উৎসাহ দেখে আমাদেরও উৎসাহ যেন একটু বাড়লো, ক্লান্তিটাও কিছু দূরে চলে গেল। মোটামুটি নিয়মমাফিক সবকিছু করে সকাল সাতটায় যখন ভোট প্রক্রিয়া শুরু হল তখন লাইনে দাঁড়িয়ে প্রায় দেড়শ পুরুষ এবং মহিলা। চারটে ব্যালট পেপারের কাউন্টার ফয়েলে ভোটারদের চারটে সই নেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু যারা একটু লেখাপড়া জানেন তারা টিপসই দিতে কিছুতেই রাজি হন না, আমরাও জোর করতে পারি না। মোটামুটি অনুরোধ করে করে টিপসই নিয়ে প্রক্রিয়াকে একটু ত্বরান্বিত করতে হলো। বাগান অঞ্চলের ভোটারদের ঠিকমতো বোঝানো হয়নি অনেকে একটা ব্যালট পেপারে চারটে ছাপ দিচ্ছেন, আবার কেউ তো প্রথমটা তে ছাপ দিয়ে বাকিগুলো এমনি এমনি ব্যালট বাক্সে ফেলে দিচ্ছেন। ব্যাপারটা বুঝতেই আমাদের কাজ আরেকটু বেড়ে গেল। ওইখানে বুথ লেভেল অফিসার হিসেবে একজন সহৃদয় মহিলা নিযুক্ত হয়েছিলেন, উনাকে দায়িত্ব দিলাম যাতে ভোটারদের একটু বুঝিয়ে দেন কি করে ভোটটা দিতে হবে, তাতে ফল হল।
তিনটে বাজতে চলল সারা দিনে দু কাপ চা আর চারটে বিস্কুট পেটে পড়েছে। কিন্তু সেটা ভেবে লাভ নেই, আসল চিন্তা হলো লাইনে তখনো অনেক ভোটার দাঁড়িয়ে। ঠিক ৩ টার সময় কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় ১০০ জন ভোটারদের টোকেন দেওয়া হল। কিন্তু তার পরেও যারা আসছিলেন, তারা সমস্যা সৃষ্টি করছেন। নির্বাচনী আইন অনুযায়ী তাদের ভোট আমরা গ্রহণ করতে পারি না, সেটা তারা বুঝতে রাজি নয়। ওদের মধ্যে একজন ফোন করে আমাদের সেক্টর অফিসারকে নিয়ে আসলেন। সেক্টর অফিসার মহোদয় জনরোষের ভয়ে আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, এই ব্যাপারে শুধু প্রিসাইডিং অফিসারেরই অধিকার আছে। আমাকে তখন তাকে জানাতে হল যে, নির্বাচনী আইন ভঙ্গ করার অধিকার প্রিসাইডিং অফিসারের নেই। উত্তেজনার পারদ চড়ছিল; বুঝলাম, যা করার আমাকেই করতে হবে। ভাগ্যিস থানা কাছেই ছিল, খবর পাঠাতেই দুজন বন্দুকধারী আমাদের সহায়তায় এগিয়ে আসলেন। ওদের বন্দুক দেখে এবং বড় গলার আওয়াজ শুনে উপস্থিত ভিড় দূরে সরে গেল। টোকেন ইস্যু করা ভোটার তখন প্রায় শেষ হতে চলেছে, বাকিদেরকে পোলিং বুথের ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা, জানালা লাগিয়ে ওরা কর্তব্য সম্পাদন করে থানায় চলে গেলেন। ভয় ছিল বেরোবার সময় হয়তো কিছু একটা ঘটেও যেতে পারে। যাক তারপর আমাদের সবগুলো নিয়মকানুন শেষ করে পোলিং এজেন্টদের বিদায় করে আমরা বের হওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম। ভাগ্য সুপ্রসন্ন, এরপরে আর এই নিয়ে কোন ঝামেলা হয়নি।
আমাদের দুটো বুথের কর্মীদের এবং লট বহর গাড়িতে গুঁজে ড্রাইভার ‘একটু আসছি’ বলে চলে গেল। প্রায় সাত মিনিট পরে সোম রস পান করে আসলো, আমরা প্রমাদ গুনলাম। আইএসবিটি চত্বরে ঢোকার আগে রামনগরে প্রায় তিন কিলোমিটার জায়গা জুড়ে ট্রাফিক জ্যামে সবগুলো যানবাহন আটকে আছে। সোমরসের কল্যাণে আমাদের ড্রাইভার ট্রাফিক আইন এবং ট্রাফিক পুলিশের বাঁশিকে তোয়াক্কা না করে প্রায় এক ঘন্টায় এই জ্যাম অতিক্রম করে এল।
ফেরার পথে দেখলাম যে জ্যাম আরও দীর্ঘ হয়েছে। চূড়ান্ত অব্যবস্থা, ভোট কর্মীরা বাধ্য হয়ে গাড়ি থেকে নেমে ব্যালট পেপার শুদ্ধ সেই ভারি ব্যালটবাক্সগুলো কাঁধে নিয়ে হেঁটে চলেছেন, জমা দিয়ে পরিত্রান পাওয়ার জন্য। ভোট সামগ্রী জমা দেওয়ার সময় এই ট্রাফিক অব্যবস্থা অনেক বৎসর ধরে চলে আসছে। দু’তিনদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের শেষে এই ঝক্কি খুবই কষ্টকর।
সবশেষে বলব বলে যেটা আগে বলিনি, সেটা হচ্ছে নির্বাচন সামগ্রী জমা দেওয়া। প্রত্যেকবার এই নিয়ে খুবই কষ্ট সইতে হয়, এবার কিন্তু আশ্চর্য রকম ব্যতিক্রম। এই সামগ্রী গ্রহণের দায়িত্বে থাকা আধিকারিক ভদ্রলোক সহাস্য মুখে আমাদের স্বাগত জানালেন এবং প্রায় ৩ মিনিটের মধ্যে আমাদের সামগ্রীগুলো সমঝে নিয়ে আমাদেরকে রিলিজ দিয়ে দিলেন, সাথে সহাস্য বার্তালাপ, তাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
তবে শেষেরও আবার একটা শেষ থাকে, ফেরার পথে প্রায় তিন কিলোমিটার হেঁটে জ্যাম মুক্ত হয়ে অন্য যানবাহন ধরতে হলো। আশঙ্কা করছিলাম, যারা পরে এসেছে তারা হয়তো আরো অনেক ভোগান্তি পেয়েছে এই ট্রাফিক জ্যামের জন্য। আমার এক বন্ধু প্রিসাইডিং অফিসার জানালেন, তিনি পরদিন সকালে সামগ্রী জমা দিয়ে বাড়ি রওনা হয়েছিলেন।
পরের দিনের স্থানীয় কাগজগুলোতে বিভিন্ন খবরে জানা গেল,কোন জায়গায় প্রিসাইডিং অফিসার প্রহৃত হয়ে টয়লেটে আশ্রয় নিয়ে সেক্টর অফিসারের মাধ্যমে পুলিশ ডেকে পরিত্রান পেয়েছেন। কেউবা আবার মুখ গুঁজে সব সয়ে গেছেন। নির্বাচন কর্মীদের এই দুঃসহ অবস্থা নিয়ে কারোর ভাবার অবকাশ নেই। নির্বাচন পরিচালনা কর্তৃপক্ষ নির্বাচন কর্মীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং আরো একটু সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারে নিশ্চয়ই চিন্তাভাবনা করা উচিত।
এই কথাগুলো নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে কিছুটা সংশোধনের ব্যাপারে মোটেই প্রভাবিত করবে না তা ভালোভাবেই জানি। কিন্তু সাধারণ জনগণ-ভোটারদের দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা যাতে পরিবর্তন হয় সেটা আমরা অবশ্যই আশা রাখতে পারি। নির্বাচন কর্মীরা যতই গুরুত্ব দিয়ে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন না কেন, কাজটা কোনদিনই ধন্যবাদের যোগ্য বিবেচিত হয় না। এটা নিয়ে জনগণ ভাবলে নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিচালনায় কিছুটা সুবিধা পেতে পারেন ‘অভাগা’ নির্বাচন কর্মীরা।
Comments are closed.