Also read in

সব ঘটনার ব্যাখ্যা মেলে না। সেই ব্যাখ্যা না মেলা ঘটনা নিয়ে অভীক রায়ের গল্প সাক্ষী

সাক্ষী   –  অভীক রায়

বিকেল থেকেই আকাশের ভাব থমথমে। তাই তড়িঘড়ি করে বগলে ছাতা নিয়ে ছুটলুম ক্লাবঘরে, বিকেলে একটু আড্ডা না দিতে পারলে পেটের ভাত হজম হয়না তো; তাই। ঢুকতে ঢুকতেই ইন্দ্রদেবের ক্রোধের ঝংকার সাথে নিয়ে ঝেপে এলো বৃষ্টি, সাথে সাথে কারেন্টও চলে গেল! ঢুকে দেখি যদুদা আর চিনুদা বসে ঝিমুচ্ছে, আমার সাড়া পেয়ে যদুদা আক্ষেপের সুরে বললে –
” মধুর দোকান তো বন্ধ হয়ে গেল, তোমাকে ফোনে কত ট্রাই করলাম ভায়া, কিন্তু বিকেল থেকে নেটওয়ার্ক নেই, নইলে স্টেশনের কাছের দোকান থেকে বেগুনি আর চা যদি নিয়ে আসতে তাহলে আজকের সন্ধ্যেটা জমতো ভালো। ”

আমিও যদুদার দুঃখকে বুকে নিয়ে সমানুভবী হওয়ার চেষ্টা করছিলাম তখনি আশুবাবু বৃষ্টিতে ভেজা কাকের মতো হাতে চা এর কেটলি আর শিঙ্গাড়া, বেগুনির পোটলা নিয়ে ঢুকলেন। মনটা খুশি হয়ে উঠলো! একদিকে পেটপুজোর আয়োজনে, অন্যদিকে আশুবাবুর আগমনে; কারণ আশুতোষ রায় বিগত ২১ বছর থেকে চাকরির সুবাদে দেশের আনাচে কানাচে অনেক ভ্ৰমণ করেছেন এবং সেই সংক্রান্ত হরেক রকমের ঘটনার গাল্পিক বিবরণ দিতে তার জুড়ি মেলা ভার।

হাতের জিনিস গুলো সবার হাতে বিলিয়ে চুপ করে বসে রইলেন একটা চেয়ারে, মুখে ক্লান্তির চিহ্ন; বেগুনিতে কামড় বসিয়ে আশুবাবুকে বললাম – “আশুবাবু, আপনার ওই সম্ভার থেকে একটা গল্প হয়ে যাক।”

একটু মাথাটা এলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন – “…হ্যাঁ রে, গল্প বলতেই তো আজ এলাম। তোদের কাছে গল্প হতে পারে, আমার কাছে সত্যি ঘটনা। আজকে তোদের যে ঘটনাটি বলবো তাঁর সঠিক ব্যাখ্যা আমার কাছেও নেই।”
একটু থেমে কি যেন ভেবে তিনি বলতে শুরু করলেন- ” তখন আমার ঝাড়খণ্ডে ট্রান্সফার অর্ডার আসে, সতীর্থদের কাছে শুনলাম শহর থেকে ৬ কিমি দূরে অফিসটি, জায়গাও নিরিবিলি শান্ত। শহরের কোলাহলে থেকে বিরক্ত হয়ে উঠেছিলাম, মনে মনে খুশিই হলাম! শেষ ট্রেন ছিল, এর মধ্যে ৪ ঘন্টা লেট; গাড়ি থেকে নামলাম রাত ১ টায়! ট্রেন চলে যাবার পর স্টেশনের অবস্থা দেখে যেন দমে গেলাম। অফিসের ক্লার্ক বিধুবাবুর আমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, হয়তো দেরি দেখে ফিরে গেছে। সাথে কিছু টাকা আর দুটো স্যুটকেস ছিল, জনমানবহীন বিদেশে রাতের অন্ধকারে তা নিয়ে যাব কোথায় এসব নিয়েই ভাবছি, তখন পেছন থেকে নূপুর পায়ে কারো হেটে যাওয়ার শব্দ পেলাম, অন্ধকারে চোখে ভালো করে ঠাহর পেলাম না – শুধু একটি আবছা অবয়ব চোখে পড়ল। পাশে গিয়ে দেখলাম ১৬-১৭ বছরের ছিপছিপে স্থানীয় একটি মেয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে, মুখ ঘোমটা দিয়ে আড়াল করা; এতো রাতে এখানে একা মেয়েকে দেখে বড়ই আশ্চর্য হলাম! হঠাৎ মেয়েটি আমাকে দেখে বলল – হামি নুনিয়া, তুকে লিয়ে যেতে এসেচি, বড়বাবু মোকে পাঠালো। যাই হোক মনে একটা খুঁতখুঁতে ভাব থাকা সত্ত্বেও একটা হিল্লে হলো ভেবে মেয়েটিকে বললাম – আমাকে তুমি চিনলে কেমন করে?

– বড়বাবু বুইলাছিলো রাতের গাড়িতেই তু আসবি; আগেও তো রাতের গাড়িতে আসলি কতবার।
ভাবলাম হয়তো আগেও কেউ এসেছিল, মেয়েটি আমাকে সেই লোকই মনে করছে। ক্লান্ত ছিলাম, তাই কথা বেশি না বাড়িয়ে মেয়েটির সঙ্গে হাঁটতে শুরু করলাম, পথে মেয়েটি একটিবারও কিছু বলল না। মেয়েটির পেছনে চলতে চলতে একটি দুতলা বাড়ির সামনে পৌঁছে গেলাম, অন্ধকারে যদিও সবকিছু একরকমই মনে হয় তবু বুঝলাম এবাড়িতে অনেকদিন থেকে কেউ থাকে না; হঠাৎ দেখি মেয়েটি নেই! ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়া শব্দ পেলাম না, এবার ভয় পেলাম! শেষমেশ কি ডাকাতের হাতে পড়লাম! লাইটারের আলোয় ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকে একটি ভাঙা তক্তপোশে বসে মেয়েটির অপেক্ষা করতে লাগলাম। বসতে বসতে ঝিমুনি ধরে গেল…। হঠাৎ একটি মেয়ের চিৎকার করে কাঁদার শব্দে তন্দ্রা ছুঁটে গেল, আর সেই শব্দ যেন আমার দিকেই ছুঁটে আসছে; চেষ্টা করলাম ওঠে দেখার কি হয়েছে কিন্তু পরক্ষণেই অনুভব করলাম আমি চলৎশক্তিহীন – বাকরুদ্ধ, আমার দেহকে যেন অদৃশ্য ভারি কিছু দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে! হঠাৎ নুনিয়া এসে আমার খাটের নিচে লুকিয়ে পড়ল, পেছন পেছন একটি পুরুষ এসে তাকে খাটের নিচ থেকে টেনে বের করে পাশবিক ভাবে নির্যাতন করতে শুরু করে, যন্ত্রনায়-কষ্টে কঁকিয়ে কঁকিয়ে উঠে মেয়েটি। আমার নিজের উপরই ঘৃণা হতে শুরু হয়, আমার সামনে এরকম অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, আর আমি কিছু করতে পারছি না, এসব দেখতে দেখতেই হঠাৎ জ্ঞান হারালাম। চোখ যখন খুলল তখন আমি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি, পুরো শরীরে ব্যথা! জ্ঞান ফিরেছে দেখে ডাক্তার বিধুবাবুকে খবর দিলেন। তিনি এসে বললেন যে আমি গত দুদিন থেকেই প্রচন্ড জ্বরে অজ্ঞান, স্থানীয় ব্যক্তিরা সকালে আমাকে পোড়োবাড়ির সামনে অচেতন অবস্থায় আবিষ্কার করে এখানে নিয়ে আসে। আমার সাথে হওয়া ঘটনাটি তাকে সবিস্তারে জানানোর পর তিনি বললেন যে বছর চারেক আগে এখানের একটি স্থানীয় মেয়ে, যে অফিসের পরিচারিকার কাজ করত; ওই পোড়োবাড়িতে শ্লীলতাহানি করে খুন করা হয়। যদিও আসামীকে ধরা যায়নি; এই ঘটনার একমাসের মধ্যে বিধুবাবুর আগে যে ব্যক্তি ক্লার্ক ছিলেন তাকে সেখানে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। স্থানীয় লোকেদের মতে সেই ব্যক্তিকে স্টেশন থেকে নিয়ে যাওয়ার সময়ই সে নুনিয়াকে তার লালসার আগুনে আহুতি দেয়। তাই নুনিয়া তাকে উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছিল।

হয়তো তাঁর উপর হওয়া অত্যাচারের সাক্ষী রাখতে চেয়েছিল আমায়, তাই প্রাণে মারেনি। বলাবাহুল্য আমি সেখানে ছয়বছর ছিলাম, আমার কোনো ক্ষতিও সে করেনি, দেখাও দেয়নি। ”

উপসংহার টেনে আশুবাবু উঠে দাঁড়ালেন চলে যাওয়ার জন্য, তখনি চিনুদা বলে উঠল – তোমার জবাব নেই আশুদা, গল্প বলার কায়দাটি তোমার নখদর্পণে।

আশুবাবু একবার পিছন ফিরে মুচকি হেসে বেরিয়ে গেল।

সঙ্গে সঙ্গে আমরা সবাই মিলে হাসতে লাগলাম, কি গল্পই না শোনালো! যদুদা ব্যঙ্গ করে বললো – পেত্নী কা ইন্তেকাম।
বৃষ্টি কমে এলো, আমরাও ক্লাব ছেড়ে যে যার ঘরে যাওয়ার তোড়জোড় করছি, হঠাৎ মুঠোফোনটি বেজে উঠলো; ওপারে আশুবাবুর ছেলে, কান্না ভেজানো গলায় বলতে লাগল -“বাবা আর নেই কাকু, বিকেলে বাইক নিয়ে বেরিয়েছিলেন, একটা গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগে……….”।

এই গল্পের গল্পকার অভীক রায় উধারবন্দে বেড়ে উঠেছেন।কাছাড় কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক পাশ করে বর্তমানে উধারবন্দ ডায়েটে ডি.এল.এড. কোর্সে অধ্যয়নরত।আঞ্চলিক পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে এই তরুণ গল্পকারের সাহিত্যে হাতেখড়ি।এর পর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হচ্ছে।

Comments are closed.