This Sunday's special: A story from Trinomoy Sen
সদগতি
শ্রাবণভেজা বিকেল। সারাদিনের ঝরা আকাশ প্রৌঢ়বেলায় একটু অন্যমনস্ক হলেও, ধূসর মেঘের দৌরাত্ম্যে চরাচরে যেন সন্ধ্যে নামছে। কয়েক বছর ধরে বসন্ত-গ্রীষ্মের ঘাড়েও বর্ষা ভর করায় সর্বত্রই সবুজের বাড়বাড়ন্ত। নদীপাড়ের বাঁশঝাড় থেকে দু-একটা বাঁশ উন্মুক্ত যৌবনের কাছে মান-ইজ্জত খুইয়ে নিবিড় চুম্বনে ডুবে আছে স্রোতস্বিনীর বুকে। কলতানের রেশ নিসর্গের বুকে ছড়িয়ে ঈশান কোণ ধরে হারিয়ে গেল একদল মুক্ত বিহঙ্গ। কচিকাঁচাদের গোলাকার বৃত্তের মাঝে মাঝে অকুস্থলে উঁকি দিচ্ছে কিছু দীর্ঘদেহী উৎসুক মুখ। লোকজনের কথাবার্তায় চাপা পড়ে যাচ্ছে মাছিদের ভনভনানি। কোমরে পেঁচিয়ে থাকা ছেঁড়া সবুজ পেটিকোট দূর থেকে চোখে পড়ায়, হল্লা-চিৎকারে এই বিচ্ছুর দলই মানুষজন জমা করেছে।
মাঝগাঙে থাকলে লাশটা চোখেও পড়তো না। শোঁ শোঁ বেগে গন্তব্যের পথ পাড়ি দিচ্ছে পাহাড়ি নদী। নোংরা কাপড়, টুকরো বস্তার সহযোগে উপর-নিচের লজ্জা ঢেকে দেওয়া হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে মেদবহুল দেহের অধিকারিনীর দুই ঊরু ফুলে আড়াআড়িভাবে লেপ্টে আছে। আধবোজা দুটো চোখ, সিঁথিতে অস্পষ্ট আভা, ঠোঁটের অনেকটা কেটে গিয়ে সাদা মাংসখন্ড ঝুলে রয়েছে। কপালের পাশে ভিড় করেছে একগোছা কাঁচাপাকা চুল। বয়স পঞ্চাশের কোঠায় হবে! দমকা হাওয়ায় ঊর্ধ্বাঙ্গের কাপড় উড়ে গেলে দু’পাশে এলিয়ে পড়া স্তন উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। ডানপাশে বীভৎস ক্ষত। লোহার ব্রাশ বা স্টিলের তন্তুর মতো কঠিন কিছুর ঘষা লেগে পেট থেকে শুরু করে স্তনের একটা পাশের ছাল উঠে গেছে। দগদগে ঘা রক্তহীন। মিতালিকে এই অবস্থায় দেখে শিউরে ওঠে সে।
সেই দিনটাও আজকের মতোই বৃষ্টিভেজা ছিল। তফাৎ বলতে, গা শিরশিরানি হাওয়ার বদলে দমবন্ধ গুমোট বিকেল। সকালে বেরিয়ে কোনো লাভ হয়নি, সন্ধ্যে নামার আগে আবার তেমাথা যেতে হবে। এই কঠিন সময়ে দু’হাজার টাকার নোটটা পেয়ে শূন্যপানে চোখ বুজেছিল রতন। রাখে হরি মারে কে! কিন্তু মুশকিল হয়েছে বাজারে যাওয়ার পর। গত ক’মাসে আশু পালের গালামালের দোকান থেকে শুরু করে সমরের ফার্মেসি, সবার খাতায় শুধু যোগ অংকই কষা হয়েছে। খুচরো করতে গেলে শ’টাকার গোটা তিনেক নোট ছাড়া আর কিছু নিয়ে ফিরে আসতে হবে না। বাকি রইলো ‘বাট্টি বৈষ্ণব’-এর ছেলের হার্ডওয়্যারের দোকান। সবার চোখ এড়িয়ে তার দোকানে গেলে, সাতসকালে আসার অজুহাতে খুচরো দিতে সাফ মানা করে দেয় আলোক।
উবু হয়ে বসে কড়কড়ে নোটখানাকে নানা ভাঁজে যত্ন করার সাথে কয়েক হাত দূরে শুয়ে থাকা রাক্ষসীকে নিঃশব্দে দেখে যাচ্ছিল রতন। ইএনডি ভাঙন রোধে বাঁধ দেওয়ার পর থেকে নদীটা এদিকে বাঁক নিয়েছে। লতানো ঝিঙে গাছ সহ সযত্নে নিকানো মিতালির সাধের উঠোনের প্রায় অর্ধেকটা গত সপ্তাহের এক সন্ধ্যায় উদরস্থ করেছে এই রাক্ষসী। দিনের বেলা যেমন তেমন করে কেটে গেলেও, রাতে ঘুম আসে না। পড়াশোনা না থাকায় সিটুকে বোনের বাড়ি গঙ্গাপুর পাঠিয়ে দিয়েছে মিতা। ফোনটা খারাপ হয়ে পড়ে আছে। তাছাড়া বেশ ক’দিন হলো বাবুদের বাড়ি যাওয়া বন্ধ, তাই মেয়ে দুটোর সাথে আর কথা হয় না। আশেপাশে বাড়িঘর নেই বললেই চলে। রতন বেরিয়ে গেলে বাড়িটা খাঁ-খাঁ করে। মেঘলা আকাশ বদ্ধ জীবনটাকে যেন স্বাদ-গন্ধহীন করে তোলে। দাওয়ায় বসে নদীর বহতা ধারাকে অবাক চোখে ভাসায় মিতা।
নিশুতি রাতে শুধু চুলো বানানো, লাকড়ি-টায়ারের ব্যবস্থা করা, হাতেগোনা লোকজনের সাথে চোলাই সহযোগে শ্মশানবন্ধুর পুণ্যার্জনের সাথে দেবরায় বাড়ি থেকে এতোগুলো টাকা পেয়ে যাবে স্বপ্নেও ভাবেনি রতন। মাস দেড়েকের অকাল বিরতির পর থেকে কাজ শুরু হলেও, থমকে যাওয়া সময়ের স্বল্প রোজগার দিয়ে দু’বেলা পেট চালানো মুশকিল। আধাবস্তা কয়লার সাথে লোহার ভারী ইস্ত্রিটা নিয়ে আবার কাজের শুরুয়াত করে আগের মতো কাজ একদিনও পায়নি।
কাকা নিবারণের কথায় একবুক আশা নিয়ে যখন রতনরা রাতের আঁধারে কাঁটাতারের এপারে আসে, তখন সে সাত-আট বছরের বালক। ভ্রাতৃস্নেহে অনেক কিছুই রতনের বাপের চোখে পড়েনি। ভাইয়ের কথায় ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে গেল সারা জীবন। বাপের মারা যাওয়ার পর বাড়ির কাগজপত্র দেখতে চাওয়ায় বাহুবল, অর্থবলের কাছে হেরে গিয়ে জীবনে দ্বিতীয়বার ভিটেছাড়া হয় সে।
বিচারের আশায় সমাজের দ্বারস্থ হলেও, উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে কিছুই হাতে আসেনি। তারপর আজ প্রায় পঁচিশ বছর পেরিয়ে গেছে। নদীপাড়ের টুকরো মাটিতে থাকতে দেওয়ার সাথে বিয়ে-টিয়ে দিয়ে নিজের রাইয়ত হিসাবে রতনকে কাছে রেখেছেন দেবরায়বাবু। মেয়ে-দুটো বিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি এনআরসিতে নাম না আসায় গত দু’বছর ধরে কোর্ট-কাছারির চক্করে জীবন সায়াহ্নে রতন আজ সর্বস্বান্ত। অনেক কাঠখড় পুড়িয়েও স্বদেশি হওয়ার প্রমাণপত্র হিসাবে কোনো কাগজ বের করতে পারেনি নিবারণের গোঁয়ার গোবিন্দ ছেলে দুটোর কাছ থেকে। অস্তিত্বসংকটের কালে তার পাশে দাঁড়িয়েছেন সত্যচরণ দেবরায়। মাস ছয়েক আগের এক সন্ধ্যেতে বাবুর হৃদয় সাড়া দিতে বন্ধ করলে আক্ষরিক অর্থেই অনাথ হয়ে পড়ে রতন।
বাজার যাবার পথে কাঠমিস্ত্রি পুলিন দাস ডাকে সাড়া না দেওয়ায় মনে কেমন একটা সন্দেহ উঁকি দিচ্ছিল। চোখে ছানি পড়ায় কাজ বাদ দিলেও পুলিনের কানের ব্যামো তো ছিল না কোনোদিন! বাজারে পৌঁছানোর পরে সন্দেহ ত্রাসের রূপ নেয়। যাওয়া-আসার পথে হাঁক পাড়া আশু পাল ভূতের মতো লম্বা হাত বাড়িয়ে ছাইরঙা নোটটা নিল অথচ দোকানে ঢুকতে দিল না! রোজদিনের মতো নামরক্ষার দোকান খুলে ফলওয়ালা দীনেশের সাথে প্যাচাল পাড়তে গেলে মাত্র দু’জন কাস্টমারের ছুতোয় তাকে পাত্তাই দিল না সে। চেনা মুখগুলো আজ দেখেও যেন দেখছে না।
— শরীর বেজুত লাগলে আমার কাছ থাইক্যা ঔষধ নিয়া যাবি রে রতন। তুই এহনো জোয়ান ব্যাটা রইছস, ঐসব বেমারে কিস্যু হইবো না তোর।
সুধাংশু সাহার কথাগুলো দুর্বোধ্য হলেও কানদুটোতে যেন হঠাৎ বেশ তপ্ত অনুভব করে সে। কোন্ বেমারের কথা বলছে এই হাতুড়ে ডাক্তার! এমন কোন্ রোগ হবার আশঙ্কা করছে সে এবং কেন!
অসময়ে দোকানের ঝাঁপ ফেলে বাড়িমুখো হলে গ্রামে নারদ নামে খ্যাত দুলু দাসের কাছ থেকে পুরো ব্যাপারটা কানে আসে রতনের। নারদের কথায় প্রাথমিকভাবে পায়ের তলার মাটি সরে গেলেও, ধীরে ধীরে সব হিসাব মিলতে শুরু করে। বাবু মারা যাবার আগে থেকেই দিদিমনি অসুস্থ, কিন্তু তাকে বিছানায় পড়ে থাকতে কোনোদিন দেখেনি রতন। অথচ হঠাৎ করে মাত্র কয়েক দিনের অসুস্থতায় চলে গেলেন! তার এমন কী হয়েছিল যে কেউ জানে না! যে গ্রামে কালবৈশাখীর ঝড় থামলেও মাঝরাতে হাঁক-ডাকে পাড়া প্রতিবেশীর খোঁজখবর নেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে, সেখানে দিদিমনিকে যখন নার্সিংহোম থেকে আনা হলো তখন তো মাত্র ন’টা বাজে। দু-একজনকে পথে চলাফেরা করতে দেখলেও বাড়ির ভেতরে বা শ্মশানে পরিচিত কেউই চোখে পড়েনি। নাক-মুখ বাঁধা ভিনদেশি লোকগুলো তাড়াতাড়ি কাজ সারবার তালে ছিল। শহুরে ছোটবাবু মুখাগ্নি করার কিছুক্ষণ পরে চলে গিয়েছিলেন। রতন না থাকলে আধপোড়া করুণাময়ী দেবরায়কে নির্ঘাত ভরা গাঙে ফেলে দিত ওরা।
অ্যাম্বুলেন্স থেকে লাশের সাথে নাক-মুখ ঢাকা সতর্ক লোকগুলোকে নামতে দেখে গত দু’দিন থেকে হাওয়ায় ভাসতে থাকা গুজব ভিত শক্ত করে নিয়েছিল। স্থানীয় লোকজনের না আসাটা শহুরে ছেলের চোখে খুব একটা অস্বাভাবিক লাগেনি। কিন্তু তাই বলে কি রতনও ব্যাপারটা খেয়াল করবে না! গজগজ করতে থাকে মিতা। আজ বাড়িখানা এই নিরালা নদীপাড়ে না হলে এসব ব্যাপার তাদের কানেও আসতো। এমনিতেই প্রায় একঘরে হয়ে আছে, এবার এই ঘটনা তাদের হয়তো গ্রামের সবার থেকে আরও দূরে করে দিলো। বউয়ের আশঙ্কা নিতান্ত অহেতুক নয়! চুপ করে ভাত গেলে রতন, কুপির টিমটিম আলো এতক্ষণে তার বুকের ভিতর ঘর করে নিয়েছে। বাইরে ঝমঝম মুষলধারার ছাঁট সিলিংহীন ঘরের মাঝে পড়লে গা শিরশিরিয়ে ওঠে। ঘুম আসে না সারারাত। ঝড়ের বেগ একটু কমলে বাইরে বেরোয় রতন। বেপরোয়া নদীর জল উঠোনে ঢুকে পড়েছে, ভয় পেলেও মিতাকে জাগায় না। মলিন চেহারায় সকালবেলার আনন্দটা আর নেই। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে।
পাহাড়িয়া জলে নদী অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। তীব্র ঢেউ আর জলোচ্ছ্বাসে ধরা দেয় তার ভয়াবহ রূপ। মানসিক-শারীরিকভাবে ক্লান্ত রতন শেষরাতে কখন ঘুমিয়ে পড়ে টেরই পায় না। কিছু একটা ঘটতে চলছে বুঝতে পেরে মিতালি বারান্দায় পা রাখতেই ঘরসুদ্ধ হুড়মুড়িয়ে জলে ধ্বসে পড়ে। মুহূর্তের জন্য শুয়ে থাকা রতনকে ডাকার প্রাণপণ চেষ্টা করলেও, ততক্ষণে চাপা পড়ে গেছে ভাঙাচোরার নিচে। দুরন্ত ঘূর্ণি তার কান-নাক হয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ে।
সকালবেলা ইএনডি বাঁধের ওপর শ’খানেক মানুষের ভিড়। বন্যার জল আশপাশের নিচু জায়গা দখল করে নিয়েছে। কেউ কেউ আঙুল দিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া ভিটার অবস্থান নির্দেশ করছে, যা আদতে ঠাহর করা প্রায় অসম্ভব। ব্যাপারটা থানায় জানানো হলেও ঘটনাস্থলে কেউ আসেনি এখনো। সারা রাতের বৃষ্টির পরে ক্ষান্ত হয়নি আকাশ, টিপটিপ বিষণ্ণতা ঝরেই যাচ্ছে অবিরত।
সত্যবাবু চলে যাওয়ার পর একাকী হয়ে পড়েছিলেন করুণাময়ী। অর্থাভাব না থাকলেও একান্তবাস ক্রমেই অসহ্য হয়ে পড়ে। একমাত্র ছেলের কর্মব্যস্ততার কাছে মা-বাবা চিরকালই গৌণ ছিল। হাই-ব্লাডপ্রেসারের রোগী করুণা নিয়মিত ঔষধপত্র নিতেন না। বেঁচে থাকার ইচ্ছে পুরোমাত্রায় লোপ পেয়েছিল তার। শরীরটা এমনিতেই ভালো যাচ্ছিল না, আগের বার স্ট্রোক হলে সত্য কাছেই ছিলেন। কিন্তু এবার আর শেষরক্ষা হয়নি।
অপরিচিত গ্রামটি অনেক দূরে, বুঝতে পেরে খুশিই হয়েছিল রতন। ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে মিতালিকে খুঁজে পেতে বেশিক্ষণ লাগেনি। পুলিশ-টুলিশকে খবর না দিয়ে মনের মতো কাজ করেছে এরা। অন্ধকার ধীরে ধীরে দখল করে নিচ্ছে দু-চোখ। কিন্তু নদীপাড়ের জায়গাটা আগুনের শিখায় অপার্থিব দেখাচ্ছে। এবার মিতালিকে শ্মশানে তোলার পালা। মুখটা প্রশান্তিতে ভরে উঠলো রতনের। মানুষ তার নির্ধারিত আয়ু নিয়েই আসে। কিন্তু আজকে নিজের গ্রামে মরলে তো কেউ ছুঁতেও আসতো না। পঞ্চভূতে বিলীন হওয়ার সাথে সদগতি প্রাপ্তি হবে তার। দুঃখ-কষ্ট সইতে যেন আর না আসে সে, কায়মনোবাক্যে একটাই প্রার্থনা এই অশরীরীর।
এই গল্পের লেখক তৃণময় সেন গ্রাম বরাকের মানুষ। কাছাড় জেলার ভাঙ্গারপার গ্রামে জন্ম নেওয়া এই গল্পকার তথা লেখক কর্মসূত্রে দিল্লি থাকেন। প্রান্তিক মানুষ ও তাদের জীবনকে মরমী কলমে আঁকাই তৃণময়ের লেখার বিশেষত্ব। বরাক উপত্যকার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তার লেখা।
Comments are closed.