Visitors in their own house; A peep into 'No Man's Land' at Indo-Bangla border in Karimganj
ভারতীয় নাগরিক হয়েও নিজ গৃহে পরবাসী: কোরণাকালে কেমন আছেন কাঁটাতারের ঘেরাটোপে বন্দি জমিরউদ্দিন, বিপুল নমঃশূদ্র, বাপন, সমীরন, নিধুরা
৫০ দিন । ১২০০ ঘন্টা । হ্যাঁ নোবেল করোনা ভাইরাস সংক্রমের কারনে দেশজুড়ে প্রথম থেকে চতুর্থ দফায় লকডাউন শেষ । এবারে আনলক ওয়ান । কিন্তু করোনা কালে ৫০ দিন থেকে ঘরবন্দি ভারত বাংলা সীমান্তে কাঁটা তারের বাইরে থাকা বাসিন্দারা । হ্যাঁ, বিগত ১০ এপ্রিল থেকে এরা কর্যত বন্দী হয়ে রয়েছে।
লকডাউনের বিভিন্ন পর্যায় আমরা দেখতে পেলাম; প্রথম দফায় কঠোর স্থিতি থাকলেও দ্বিতীয় দফায় লকডাউন থেকে অনেক কিছু শিথিল হলো। কিন্তু কাঁটাতারের বাইরে থাকা বাসিন্দাদের যে ঘরবন্দি করা হয়েছিল, এদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হলো না । এরাও ভারতীয় নাগরিক, জাতীয় নাগরিক পঞ্জিতে নাম ও রয়েছে, রয়েছে জাতীয় নাগরিক পরিচয় পত্র । এতকিছু থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে বন্দিত্বের জীবন চলছে ।
স্বাধীনতা যে কি জিনিস এরা কিন্তু জানতে পারেন নি আজ অবধি । বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমন ছড়াচ্ছে যার কারনে নো ম্যান্স ল্যান্ডে থাকা ভারতীয়রা তাদের মাতৃভূমিকে প্রবেশ করলে করোনা সংক্রমন ছড়াতে পারে নিজের দেশে । বাংলাদেশে ঈদের পরে শিথিল করা হয়েছে লকডাউন । সামাজিক দূরত্ব মেনে স্বাভাবিক হচ্ছে সেখানের জনজীবন । কিন্তু বাংলাদেশের করোনা সংক্রমনের প্রভাব পড়বে দেশে, এই কারনে সীমান্ত সিল করে দেওয়া হয়েছিল কেন্দ্রীয় গৃহ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ।
এই যে দেড় মাসের বেশি সময় অতিবাহিত এতদিনে এরা কি জীবিত রয়েছেন না মৃত এর খবর রাখে কে ? প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া দুই দিন দশ কেজি চাল, পাঁচ কেজি ডাল আর দুই কেজি লবন দিয়ে এদের কতদিন চলবে ? কিভাবে এরা বাঁচবেন ! বলতে গেলে কাঁটা তারের বাইরে থাকা প্রায় সব মানুষই কৃষিজীবী, দিনমজুর । এমনিতে লকডাউনের কারনে কর্মহীন । নুন আনতে পান্তা ফুরায় এমন অবস্থায় কি দিয়ে এই মহাসঙ্কটের সময় দুমুঠো অন্নের ব্যবস্থা করবেন ।
লামজুয়ারে ৩, লাফসাইলে ৫৯, জারাপাতায় ২, গোবিন্দপুরে ৪০, লাতু কান্দিতে ১০, তেশুয়ায় ১, কুয়োরভাগে ১, মহিষাশনে ৩, দেওতলীতে ৯ পরিবার । কমবেশি প্রায় ৭৫০ জনের মতো বাসিন্দা । কিন্তু এই কয়েকটা পরিবারের দায়িত্ব নিতে অক্ষম করিমগঞ্জ জেলা প্রশাসন । দুর্যোগের সময় ত্রান সামগ্রী দিয়ে সাহায্য করেছেন অনেক দল সংঘটন । বিএসএফের কঠোর স্থিতি, চোখ রাঙানি থাকলেও এই অসময়ে জেলা প্রশাসনের চেয়ে যথেষ্ট সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনীর করিমগঞ্জ সীমার দায়িত্বে থাকা ০৭ নং ব্যাটালিয়ন । তবে এক একটা ত্রান সামগ্রীর প্যাকেটে থাকা চাল, ডাল, আলু দিয়ে একটি পরিবারের কদিন চলবে একথা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কার্যালয়ে থাকা প্রশাসনিক কর্তাদের বোঝাবেটা কে ? দেশ ভাগের বলি এরা, কাঁটাতারের কবলে পড়ে এরা ভারতীয় মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন । কিন্তু এই বিচ্ছেদ যে তাদেরকে ছিঁড়ে ফুঁড়ে খাবে, বাস্তব যে এমন ভয়াবহ হবে তাঁর আঁচ কিন্তু আগে করতে পারেন নি লাতুর কান্দির সত্তরঊর্ধ্ব মুহিবুর রহমান । ৯০ দশকে কাঁটাতার তাদের ভাগ করে দেয় । তখন যদি আজকের দিনের কথা বুঝতে পারতেন তখন হয়তো তারা এই দেশের আশাই হয়তো ছেড়ে দিতেন । পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী তিনি নিজে । সদস্য সংখ্যা চারজন । এই বয়সে হাতুড়ি, টাঙি নিয়ে রাজ মিস্ত্রির কাজ করেন । দুই মেয়ে বিবাহিত । আলো পৌঁছেনি সেখানে । কাঁটা তারের বাইরে রাজ্য সরকারের বিদ্যুৎ বাতি তো দূরের কথা । বাড়ির মোবাইল চার্জের অভাবে কদিন আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে । আত্মীয়স্বজন, নিজের মেয়ে, নাতি, নাতনির সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন । বাড়িতে মা, বাবা কিভাবে আছেন তাঁর খোঁজ নিতে পারছেন না মেয়েরা ।
কুয়োরভাগের জমির উদ্দিন । এখানে মাত্র একই পরিবার । প্রতিবেশীরা সচ্ছল থাকার দরুন কয়েকবছর আগেই জমি কিনে কাঁটাতারের বাঁধন থেকে বেরিয়ে এসেছেন । জমির উদ্দিনের পরিবারের সদস্য সংখ্যা আটজন । নিজে কৃষিজীবী মানুষ । বাড়িতে বা নিজের জমিতে সব্জি চাষ করে বাজারে বিক্রি করে কোনভাবে দিন গুজরান করেছিলেন । তবে করোনা কালে আজ সমূহ বিপদগ্রস্ত । ক্ষেতের সব্জি নষ্ট হচ্ছে । ঘরে আটজন সদস্যর মধ্যে তিনজন শিশু । কিভাবে কি করবেন দিশেহারা । স্ত্রীর জনধন যোজনার একাউন্ট রয়েছে নিকটবর্তী ব্যাঙ্কে । বিপদের বন্ধু হিসাবে কিছু টাকা নিজে থেকে সঞ্চয় করে রেখেছিলেন জনধন খাতায় । ইদানিং উজ্জ্বলা যোজনার টাকাও জমা হয়েছে ব্যাঙ্কে । কিন্তু এবারে যে বিপদের বন্ধু ব্যাঙ্ক একাউন্ট কাজে আসছে না – লোহার গেট বন্ধ । মধ্যে মধ্যে পানীয় জল দিয়ে যায় বিএসএফ । কাঁটা তারের কাছে দাঁড়িয়ে ভাঙা গলায় জমির উদ্দিন বলেই দিলেন, বাবু বড় অসহায় । অনেক আবেদন করলাম বিএসএফের কাছে একবার ব্যাঙ্কে যাওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য । কিন্তু কোন লাভ হয়নি । উপর মহলের কোন নির্দেশ না আসা অবধি গেট বন্ধ থাকবে বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন ক্যাম্পের বড় সাহেব । তবে বড়ো ভালো এখানের দুই বিএসএফের সাহেব । হয়তো ভগবান এদের পাঠিয়েছেন এই অসময়ে, জানালেন জমির উদ্দিন । প্রায় সময় গাড়ি থামিয়ে হর্ন বাজিয়ে ডেকে এনে খোঁজ নেন । খাদ্য সামগ্রী এনে দিয়েছেন কয়েকদিন ।
গোবিন্দপুর ৪০ পরিবার । এর মধ্যে ৩৭ পরিবার তফসিলি জাতি । বিপুল নমঃশূদ্র, বাপন, সমীরণ, নিধু, দিলীপ সবার মুখে এক কথা । বিধায়ক, সাংসদ, জেলাশাসক সবাই এসেছেন । দিনে এক ঘন্টা করে গেইট খুলে দেওয়ার জন্য অনুরোধের খামতি করিনি আমরা । সবাই বলে গেলেন । কিন্তু ভাগ্য আমাদের বদলায় নি । এবারে খাঁড়ার উপর মরার ঘা । করোনা কাল ছেড়ে বন্যার কবলে পড়ছেন তাঁরা । প্রতিবার বন্যার জলে ডুবে থাকে তাদের গ্রাম । কিছু দিনের জন্য থাকতে হয় বন্যা ত্রাণ শিবিরে । ২৫০ এর বেশি এই গ্রামের বাসিন্দা । সবার ঘরেই আর্তনাদ । গ্রামের এক পরিবারের বিকলাঙ্গ এক শিশু মারা গেছে কদিন আগে । চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতে পারেন নি করিমগঞ্জে । এবারে শ্রাদ্ধানুষ্ঠন কিভাবে সারবেন দুশ্চিন্তা রয়েছে মাথায় । কয়েকজন তো বলেই দিলেন, দাদা এখানে ভোট বেশি । প্রথম প্রথম ত্রাণের কোন অভাব করিনি আমরা । বিধায়ক, সাংসদ, শাসক দলের নেতারা প্রথম প্রথম সবাই এসে মায়া কান্না দিয়ে ত্রাণের প্যাকেট দিয়ে গেছেন । কিন্তু এখন ডুমুরের ফুল এরা । এবারে আর বিধায়ক, সাংসদের ত্রান নেবো না । ত্রাণের বদলি বিষের বোতল চাইবো । যে দেশ আমাদের চাইছে না সেখানে আমরা থেকেই বা লাভ কি ?
একই অবস্থা লাফসাইল গ্রামে । এখানে জনবসতি বেশি । মৎস্যজীবী বেশির ভাগ । কি করবেন, কিভাবে বেঁচে থাকবেন দুশ্চিন্তা ঘরে ঘরে । নিজেদের ছেলে বাড়ির লোকেরা বহিঃরাজ্যে কর্মরত । অনেকে নিজের ঘরে আসতে পারবেন না বলে ফিরছেন না, আর অন্য রাজ্য থেকে যারা ফিরেছেন তাদের মধ্যে কয়েকজন রয়েছেন কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে। আর যাদের কোয়ারেন্টাইন থাকার মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে তারা কি করবেন । নিজের বাড়িতে আসার অনুমতি টুকু এদের নেই যার কারনে বাধ্য হয়ে থাকতে হচ্ছে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা শ্বশুরবাড়ির অতিথি হয়ে । ত্রিশ বছর ধরে বন্দিত্বের জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন তারা । কিন্তু এই করোনাকাল আরো উলটপালট করে দিল, কবে শেষ হবে এনিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই । কোন উত্তর নেই সীমান্ত দাঁড়িয়ে থাকা রক্ষীদের কাছে । না উত্তর আছে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে।
Comments are closed.