Also read in

ত্রুটিপূর্ণ এনআরসি: বরাকের জনপ্রতিনিধিদের পদত্যাগের দাবি জানালো আভা ও গৈরিক ভারত

এনআরসি তালিকা থেকে বাদপড়া ১৯ লক্ষের মধ্যে মাত্র ছয় লক্ষ মুসলমান এবং এর দ্বিগুণ হিন্দু রয়েছেন। ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন, ২০১৬ অসম বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির একমাত্র প্রতিশ্রুতি ছিল হিন্দুদের সুরক্ষা দেওয়া। এব্যাপারে অসমের বিভিন্ন নেতারা মুখ খুললেও অদ্ভুতভাবে নীরব বরাক উপত্যকার বিজেপি বিধায়ক ও সাংসদরা। আমরা বারবার তাদের কথায় কান দিয়েছি এবং আজ মনে হচ্ছে আমরা এক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছি, তাই আমরা দাবি করছি হিন্দুদের সুরক্ষার দাবিতে আপনারা পদত্যাগ করুন, এমনটাই দাবি সারা আসাম হিন্দু বাঙালি অ্যাসোসিয়েশন, গৈরিক ভারত সহ বিভিন্ন হিন্দু সংগঠনের।

৩১ আগস্ট তালিকা প্রকাশের পর থেকেই বিভিন্ন উপত্যকার বিভিন্ন হিন্দু সংগঠন এনআরসির সমন্বয়ক প্রতীক হাজেলার বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। সোমবার বিকেলে শিলচরে পার্ক রোডের ক্ষুদিরাম মূর্তির সামনে তারা একত্রিত হন এবং ঘন্টাখানেক ধর্না প্রদর্শন করেন। এতে যোগ দেন উপত্যকার বেশ কিছু বিশিষ্ট নাগরিকরাও। প্রায় কয়েকশ মানুষ একসঙ্গে আওয়াজ তোলেন যে এনআরসি নিয়ে হিন্দুদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।

সারা আসাম বাঙালি হিন্দু অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বাসুদেব শর্মা বলেন, ১৯ লক্ষের মধ্যে মাত্র ১১ লক্ষ হিন্দু রয়েছেন, তাই এই তালিকাটি ত্রুটিপূর্ণ। দুবারের লোকসভা নির্বাচন এবং অসম বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল হিন্দুদের সুরক্ষা দেওয়া। হিন্দুদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে ভোট পেয়েছিলেন। শাসকদলে থাকার পরও রাজ্যের বাঙালি হিন্দুরা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। গতবছর এনআরসির খসড়া প্রকাশের পর থেকেই আমরা বুঝতে পেরেছিলাম হিন্দুদের বাদ দেওয়ার এক বিশাল ষড়যন্ত্র চলছে। অথচ এনআরসি তৈরি করার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ভারতে ঢুকে পরা মুসলমানদের চিহ্নিত করা। শনিবার সকালে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর রাজ্যের অর্থমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা, বিজেপির সভাপতি রঞ্জিত দাস, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কবীন্দ্র পুরকায়স্থ সহ বিভিন্ন নেতারা এর বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। অথচ বরাক উপত্যকার দুই নবনির্বাচিত সাংসদ এবং অন্যান্য বিজেপি বিধায়করা এখন পর্যন্ত এব্যাপারে একটি কথাও বলেননি। তারা নির্বাচনের প্রচারে মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে হিন্দুত্বের দোহাই দিয়ে ভোট চেয়েছিলেন। এবার যখন হিন্দুদের পাশে দাঁড়ানোর সময় এসেছে তারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। তাই আমরা তাদের পদত্যাগ দাবি করছি।
অসম চুক্তি এবং অতীতে অসমে বাঙালিদের উপর হওয়া বিভিন্ন নির্যাতনের কথা টেনে তিনি বলেন, দেশভাগের পর সিলেট আসামে থাকবে কিনা এব্যাপারে একটি ভোটাভুটি হয়েছিল। তখন এই অঞ্চলের চা জনগোষ্ঠীর মানুষকে ভোটে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। আজ তারা অরিজিনাল ইনহেরিটেন্স হিসেবে এনআরসিতে জায়গা পেয়েছেন। অথচ যে বাঙালিরা সেই ভোটেও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল তারা আজও বিদেশি।

১৯৮৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী সারা আসাম ছাত্র সংগঠন (আশু) নামের একটি সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে অসমের জন্য নতুন আইন বানালেন, তখনও বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব অস্বীকার করা হয়। এবার মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালের নেতৃত্বে অসম চুক্তির ৬-নম্বর ধারা চালু করার জন্য নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং এই কমিটিতে বাঙালির প্রতিনিধিত্ব নেই। আমরা অসম চুক্তি মানিনা, কারণ এতে শুধু অসমিয়া জনগোষ্ঠীর স্বার্থের কথা রয়েছে। আমরা এই দেশের বাসিন্দা এবং আমাদের বাদ দিয়ে কোন আইন প্রণয়ন করা যাবে না। আমাদের এই কথাগুলো যারা গিয়ে গুয়াহাটিতে বা দিল্লিতে বলবেন বলে দায়িত্ব নিয়েছেন, সেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা আজ নীরব। এই দুঃসময়ে তারা যদি বাঙালির পাশে না থাকেন তাহলে ভবিষ্যতে তাদের ছুঁড়ে ফেলে দিতে আমাদের অসুবিধা হবে না।

বরিষ্ঠ সাংবাদিক এবং কবি অতীন দাশ বলেন, আমরা এবছরের প্রথম দিকে লোকসভা নির্বাচনে একটি অদ্ভুত প্রচার শুনেছিলাম। বিজেপি দলের পক্ষে বলা হচ্ছিল, নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতা এতটাই বেশি যে একটি কলাগাছকেও যদি বিজেপির প্রার্থী করা হয়, তবুও তাকে হারানো সম্ভব হবে না। এবার এনআরসির তালিকা প্রকাশের পর আমাদের ভোটে জয়ী হওয়া প্রতিনিধিদের দেখে মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতে আর যাই হোক কোনও কলাগাছকে ভোট দেবো না। দেশভাগের পর জওহরলাল নেহেরু, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল, মহাত্মা গান্ধীর মত নেতারা নিজের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে দেশভাগের সম্মতি দিয়ে আমাদের এই দুর্দশায় ফেলেন। তারা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে আটকাতে চেয়েছিলেন এবং একই সঙ্গে বাঙালির কোমর ভেঙে দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল। তারা তাদের উদ্দেশ্যে সফল হয়েছেন এবং আজও তাদের পরবর্তী প্রজন্ম একই কাজ করছে। যে বাঙালিরা দেশভাগের দুর্দশা নিজের চোখে দেখেছেন তাদের তিন প্রজন্ম পরেও আমাদের প্রতিনিয়ত প্রমাণ করতে হচ্ছে আমরা ভারতীয়। তবে দুর্ভাগ্য হচ্ছে আমাদের প্রতিনিধিরা এসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মত সাহস রাখেন না।

গৈরিক ভারতের শান্তনু নন্দন ভট্টাচার্যের দাবি, ধর্মের ভিত্তিতে যখন দেশ ভাগ হয়েছিল তাহলে ভারতবর্ষে হিন্দুদের নিঃশর্ত নাগরিকত্ব দিতে হবে। সংগঠনের আরেক সদস্য মণিভূষণ চৌধুরী বলেন, এবার থেকে আমরা নিজেদের সচেতন করে তুলবো। আর গান্ধী বা নেহেরুর নামে কোনও দিন উদযাপন হবে না। আমি সন্তদাস কাঠিয়া বাবার বংশধর, একজন হিন্দু, তবু আমার নাম খসড়ায় ছিল না। আর হিন্দুত্বের নামে ভোট চেয়ে কেউ আমাদের ঠকাতে পারবেন না, এবার থেকে তীব্র আন্দোলন হবে।

Comments are closed.