Also read in

On the eve of Mahalaya residents are busy paying respect to forefathers - Tarpan

কাল মহালয়া, পিতৃপক্ষে তর্পণের শেষ দিন – “তৃপ‍্যন্তু সর্বমানবা”

আগামীকাল মহালয়া, পিতৃপক্ষের শেষ, দেবীপক্ষের সূচনা। মহালয়ার শারদপ্রাতে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের অপূর্ব সৃষ্টি “মহিষাসুরমর্দিনী” শুনে বাঙালির ঘুম ভাঙবে। অনেকে রেডিও খুঁজে বের করে রাখবেন, কেউ বা মোবাইল থেকেই চালিয়ে দেবেন সেই মহিষাসুরমর্দিনী। সাত সকালে সবাই বেরিয়ে পড়বেন সদরঘাট ব্রিজের উদ্দেশ্যে “মহালয়া দেখতে”।

সাথে সাথে নদীতে নদীতে, পুকুরে বা নিদেনপক্ষে বড় পাত্রে জল নিয়ে চলবে পিতৃ তর্পণ। উচ্চারিত হবে, “ওঁ পিতা স্বর্গঃ পিতা ধর্মঃ পিতাহি পরমং তপঃ। পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রীয়ন্তে সর্বদেবতা।।” এ বৎসর পিতৃপক্ষ শুরু হয়েছে ২৬শে সেপ্টেম্বর, বুধবার। পুরো পনেরো দিন ধরে চললেও, মহালয়াতে পিতৃপক্ষের শেষ এবং দেবীপক্ষ বা মাতৃ পক্ষের সূচনা লগ্নে সবচেয়ে অধিক সংখ্যক লোক তর্পণ করে থাকেন। কিন্তু তর্পণের মাহাত্ম্য বা উদ্দেশ্যটা কি, যারা তর্পন করেন তাদের মধ্যেও অনেকে এই বিষয়ে সম্যক ধারণা রাখেন না।

পিতৃপুরুষের কাছে আমরা ঋণী। তাই তাঁদের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য একটি বিশেষ দিন-ক্ষণের প্রয়োজন। সেই বিশেষ দিন গুলি হলো পিতৃপক্ষ। এই দিনগুলোতে পিতৃপুরুষের উদ্দেশে তর্পণ করা হয়। তাঁদের আত্মাকে তৃপ্ত করার জন্য তিল, জল, দান করা হয়। বলা হয়ে থাকে, যমালয় থেকে মর্ত্যলোকে এ সময় পিতৃ পুরুষেরা আসেন। তাহাদের যাত্রাপথকে আলোকিত করার জন্য উল্কাদানও করা হয়। এই তর্পণে খুবই সাধারণ কয়েকটা সামগ্রী লাগে যেমন তিল, হরিতকী, তণ্ডুল বা চাল, ফুল, দূর্বা, তুলসী পাতা ইত্যাদি।

মহাভারতে বলা হয়েছে যে, মহাবীর কর্ণের আত্মা স্বর্গে গেলে সেখানে তাঁকে খেতে দেওয়া হল শুধুই সোনা আর ধনরত্ন। অবাক হয়ে কর্ণ এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন ইন্দ্রকে । ইন্দ্র বললেন, ‘তুমি সারাজীবন সোনাদানাই দান করেছো, পিতৃপুরুষকে জল দাও নি। তাই তোমার জন্যে এই ব্যবস্থা।’ কর্ণ বললেন, ‘আমার কী দোষ? আমার পিতৃপুরুষের কথা তো আমি জানতে পারলাম যুদ্ধ শুরুর আগের রাতে । মা কুন্তী আমাকে এসে বললেন, আমি নাকি তাঁর ছেলে। তারপর যুদ্ধে ভাইয়ের হাতেই মৃত্যু হলো। পিতৃতর্পণের সময়ই তো পেলাম না ।’ ইন্দ্র বুঝলেন, কর্ণের দোষ নেই। তাই তিনি কর্ণকে পনেরো দিনের জন্য মর্ত্যে ফিরে গিয়ে পিতৃপুরুষকে জল ও অন্ন দিতে অনুমতি দিলেন।

ইন্দ্রের কথা মতো এক পক্ষকাল ধরে কর্ণ মর্ত্যে অবস্থান করে পিতৃপুরুষকে অন্নজল দিলেন। তাঁর পাপ স্খলন হলো এবং যে এক পক্ষকাল কর্ণ মর্ত্যে এসে পিতৃপুরুষকে জল দিলেন সেই পক্ষটি পরিচিত হল পিতৃপক্ষ নামে।

তর্পণের বিশেষত্ব হচ্ছে যে, শুধু নিজের পূর্বজদের নয়, বা স্বধর্মের নয় সমগ্র মানব জাতির সকল ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে প্রয়াত সবাইকে আহবান করে ওদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয় এই মন্ত্র,

‘অতীত কুল কোটীনাং সপ্তদ্বীপ নিবাসিনাম।
ময়াদত্তেন তোয়েন তৃপ‍্যন্তু ভুবনত্রয়ম।’

অর্থাৎ যে সকল মানুষ একদা এই পৃথিবীতে ছিলেন, এখন গত হয়েছেন, সপ্ত দ্বীপ খন্ডিত এই বিচিত্র দেশগুলোতে সময়ের শুরু থেকে যারা বসবাস করে গিয়েছেন, তাদের সকলেরই উত্তরসূরী আমরা । আমার দেওয়া এই তর্পনের জলে অন্তরের শ্রদ্ধা জনিত তিন ভুবনের সকল তৃষিত,তাপিত আত্মার তৃপ্তি হোক; অতৃপ্তির তৃষ্ণা থেকে মুক্তি হোক ।প্রার্থনা এই, “তৃপ‍্যন্তু সর্বমানবা” – আমার দেওয়া এই জলে তৃপ্ত হোক সকল মানুষ।

আবার নাভি পর্যন্ত জলে দাঁড়িয়ে স্মরণ করা হয় অপুত্রক, যার জল দান করার কেউ নেই, যিনি দুর্ঘটনায় বা অপঘাতে মারা গেছেন তাদেরও। এই তর্পণের মাধ্যমে এক সার্বজনীন বিশ্বকল্যাণ এবং উদারতার চিত্র ফুটে উঠে।

Comments are closed.

error: Content is protected !!