নজিরবিহীনই বটে! ২০ টি নিষ্ক্রিয় স্কুল, কলেজ এবং ক্লাবের সদস্য পদ বাতিল করল শিলচর জেলা ক্রীড়া সংস্থা। শনিবার সংস্থার গভর্নিং বডির (জি বি) বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রবিবার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এমনটা জানান সংস্থার সচিব বিজেন্দ্র প্রসাদ সিং। হঠাৎ করে কেন এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, তার কারণও ব্যাখ্যা করেছেন সচিব। এদিনের জিবি তে মোট ১৪ টি এজেন্ডা ছিল। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা ছিল সংস্থার সদস্যপদ নির্ধারণ করা। আর এটা করতে গিয়েই কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসার মত অবস্থা।
এখানে প্রশ্ন আসতে পারে হঠাৎ করে কেন সংস্থার সদস্যপদ নিয়ে প্রশ্ন উঠলো? যারা এতটা বছর ধরে সংস্থার সদস্য বনে রয়েছেন হঠাৎ করে কেন তাদের সদস্যপদ যাচাই করার প্রয়োজন পড়ল? এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সচিব বিজেন্দ্র বলেন, ‘সংস্থার সদস্য হিসেবে এমন বেশ কয়েকটি স্কুল কলেজ এবং ক্লাব রয়েছে যারা গত কয়েক বছর ধরেই একেবারে নিষ্ক্রিয়। সংস্থার কোনো ইভেন্টেই এইসব ক্লাব এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলি অংশগ্রহণ করেনি। অথচ এই ক্লাব ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি দিব্যি সংস্থার সদস্য বনে আছে। সংস্থার সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। আর বিজিএমে এসে সেইসব নিষ্ক্রিয় ক্লাব ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতিনিধিরা ভোট দিয়ে যাচ্ছেন।’
আসলে সংস্থার শেষ বি জি এমে যে ঝামেলা সূত্রপাত হয়েছিল, তার সমাধান করার জন্যই টিম বিজেন্দ্র এই উদ্যোগ নেয়। শুরু হয় শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া। অসম অলম্পিক সংস্থা (আই ও এ) আজ পর্যন্ত ডি এস এর বর্তমান কর্ম সমিতিকে স্বীকৃতি দেয়নি। এর কারণ হলো কয়েক বছর আগে দেওয়া আই ও এর বিবৃতি অনুসারে, শিলচর জেলা ক্রীড়া সংস্থার বর্তমান কমিটি সংবিধান অবমাননা করেছে। সংস্থার সংবিধানের সঙ্গে তাদের ‘ভোটার লিস্ট’ এর কোনও মিল নেই। আজীবন সদস্য পদ যাদের রয়েছে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। সংবিধান বলছে শুধু ১৫ জন আজীবন সদস্য সংস্থায় ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। এ নিয়েই শেষ বিজিএম থেকে ঝামেলার সূত্রপাত ঘটেছিল। এই সব সমস্যা সমাধানের জন্যই টিম বিজেন্দ্র সংবিধান সংশোধন সহ সদস্যপদ খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই অনুসারে শুরু হয় কাজ।
বিজেন্দ্র বলেন, ‘শেষ বিজিএম নিয়ে যে ঝামেলা হয়েছিল তার ফলে আজ পর্যন্ত আই ও এ বর্তমান কমিটি কে স্বীকৃতি দেয়নি। তাদের বক্তব্য ছিল, আমরা সংবিধানের অবমাননা করেছি। সমস্যা রয়েছে আমাদের সদস্য পদ নিয়ে ও। তাই যেসব জটিলতা রয়েছে সেগুলি যদি সারিয়ে তোলা না হয় তাহলে আগামীতে যে কমিটি দায়িত্বভার গ্রহণ করবে, তাদের ও ভুগতে হবে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিই, আমায় যে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে পরবর্তী কমিটিকে যাতে সেগুলির মুখে পড়তে না হয়।’
সচিব জানান, সংবিধানে যেসব ফাঁকফোকর রয়েছে সেগুলি ভরাট করার জন্য একটা পৃথক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটির পরামর্শ দিয়েছে এখন থেকে প্রত্যেক আজীবন সদস্য ও ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। জিবিতে এটা পাস হয়ে গেছে। এর ফলে আজীবন সদস্যদের ভোটাধিকার নিয়ে যে সমস্যা ছিল তা আর থাকবে না। সচিব আরো জানান, সংবিধান অনুসারে যদি কোন ক্লাব বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান টানা দুটি টার্ম নিষ্ক্রিয় থাকে অর্থাৎ সংস্থার কোন ও ইভেন্টে অংশগ্রহণ না করে তাহলে সেই ক্লাব অথবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সদস্য পদ বাতিল হয়ে যাবে। সেই অনুযায়ী শনিবার জিবিতে এমন নিষ্ক্রিয় থাকা কুড়িটি ক্লাব ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ বাতিল করে দেয় সংস্থা। এটাও কিন্তু এক প্রক্রিয়া অনুসারেই সম্পন্ন হয়েছে। হঠাৎ করে কোন কিছু হয়নি।
গত বছর ২১ সেপ্টেম্বর সংস্থার সচিব ই ক্যাটাগরির মোট ২৭ টি স্কুল-কলেজকে এক চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সেই চিঠিতে সচিব স্কুল কলেজ গুলির খেলাধুলা সংক্রান্ত রিপোর্ট চেয়ে ছিলেন। অর্থাৎ গত কয়েক বছরে তারা সংস্থার কোন কোন ইভেন্টে অংশ নিয়েছেন, আদৌ নিয়েছেন কি, সে ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলেন। চিঠিতে এটাও উল্লেখ ছিল যে যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোনো জবাব না আসে তাহলে ধরা হবে যে এই স্কুল কলেজ গুলি সংস্থার কোনো স্পোর্টস ইভেন্টে অংশগ্রহণ করেনি। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এমন চিঠি পাবার পরও শুধু একটি কলেজ জবাব দিয়েছে। ৯৫ শতাংশ সংস্থার চিঠির জবাব দেওয়ার প্রয়োজন টুকু মনে করেনি। ই ক্যাটাগরির স্কুল কলেজ গুলির কাছ থেকে এমন ‘রেসপন্স’ পাবার পর সংবিধান অনুসারে পদক্ষেপ গ্রহণ করে টিম বিজেন্দ্র। ই ক্যাটাগরির স্কুল কলেজ গুলির পারফরম্যান্স খতিয়ে দেখার পর যে চিত্র সামনে এসেছে তা খুবই উদ্বেগজনক। স্থানীয় খেলাধুলার ক্ষেত্রে সেটা খুবই নেতিবাচক খবর। দেখা গেছে ই ক্যাটাগরির মোট ২৭ টি সদস্যের মধ্যে শুধু ১১টিই অ্যাক্টিভ। বাকি ১৬টি স্কুল-কলেজ খেলাধুলার ক্ষেত্রে একেবারে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে রয়েছে। এই তালিকায় রয়েছে গুরুচরণ কলেজ ও কাছাড় কলেজ এর মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। রয়েছে অধরচাঁদ এইচএস স্কুল, টাউন হাইস্কুল, সাউথ পয়েন্ট, এ কে চন্দ লো কলেজ, ডি এন এন কে এবং গভমেন্ট গার্লস এর মত মর্যাদাসম্পন্ন স্কুল গুলি ও। ই ক্যাটাগরির মোট ১৬ টি স্কুল-কলেজ কে নিজেদের সদস্যপদ থেকে ছাঁটাই করেছে সংস্থা। এখানেই শেষ নয়, এ ক্যাটাগরির মোট কুড়িটি ক্লাবের মধ্যে কাছাড় পুলিশ এসি কেও সদস্যপদ থেকে বাতিল করা হয়েছে। জি ক্যাটাগরির মোট ৩৩ টি ক্লাবের মধ্যে তিনটি কে সংস্থার সদস্যপদ থেকে বাতিল করা হয়েছে। এই তিনটি ক্লাব হচ্ছে ইরিগেশন আরসি, পি এইচ ই আর সি এবং শিলচর ব্রিজ ক্লাব। এই সকল নিষ্ক্রিয় ক্লাব এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সদস্যপদ থেকে বাতিল করার ফলে সংস্থার মোট ৩০টি ভোট কমবে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, এর আগে সংস্থার কোনো সচিব এই ফাঁকফোকর গুলির দিকে নজর দেন নি। সম্ভবত এর প্রধান কারণ ছিল ভোট অংক। তবে সচিব বিজেন্দ্র ও তার টিম এই পথে হাঁটেনি। ভোট ব্যাংকের চিন্তা না করেই সচিব এই নিষ্ক্রিয় ক্লাব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির রিপোর্ট জিবি তে পেশ করেন। যা সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়ে যায়।
জিবিতে সংবিধান সংশোধনী বিষয়গুলি অনুমোদন পাওয়ার পর এবার বিশেষ সাধারণ সভায় অনুমোদন হাসিল করতে হবে। আগামী ৩১ অক্টোবর বিশেষ সাধারণ সভা ডাকা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজেন্দ্র। জিবি বৈঠকে সংস্থার ৭ এসোসিয়েট ক্লাব কেও ছাঁটাই করা হয়েছে। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ডি ক্যাটাগরিতে থাকা সত্ত্বেও এতদিন জাতীয় ব্যায়াম বিদ্যালয়ের ছয়টি ভোট ছিল। বিশেষ মর্যাদায় জাতীয় ব্যায়াম বিদ্যালয় কে এই ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল। আসলে যখন এই বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল তখন জেলার একমাত্র ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ ক্লাব হিসেবে স্বীকৃতি ছিল জাতীয় ব্যায়াম বিদ্যালয় এর। তবে এখন চিত্রটা পুরোপুরি পাল্টে গেছে। এখন জেলায় অনেক ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ ক্লাব রয়েছে। সংস্থার নিজেরই একটা ফিজিক্যাল শাখা রয়েছে। তাই এখন আর জাতীয় ব্যায়াম বিদ্যালয় কে বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার কোনো যুক্তি হয় না। এই যুক্তিতে ই জাতীয় ব্যায়াম বিদ্যালয়ের ভোট সংখ্যা কমিয়ে দুইয়ে আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। জিবিতে এটা অনুমোদন পেলেও এবার স্পেশাল জেনারেল মিটিংয়ে এতে সিলমোহর পড়তে হবে।
সেই সঙ্গে এখন থেকে ই ক্যাটাগরিতে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অথবা সরকারি অফিস তাদের প্রতিনিধি পাঠাবে তা নিয়েও সংবিধানের সংশোধনী আনা হয়েছে। নতুন সংশোধনী অনুসারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আসা প্রতিনিধি কে অবশ্যই সেই প্রতিষ্ঠানের কর্মরত হতে হবে। একইভাবে সরকারি কার্যালয় থেকে আসা প্রতিনিধিদের সেই নির্দিষ্ট বিভাগে চাকরি রত হতে হবে।
বিজেন্দ্র জানান জিবি বৈঠকে আরো বেশ কিছু বিষয় অনুমোদন পেয়েছে। সে অনুসারে আগামী ১নভেম্বর থেকে শুরু হবে সংস্থার ক্রিকেট মরশুম। তার আগে ২৩-২৪ ও ২৫ অনুষ্ঠিত হবে আন্তঃক্লাব দলবদল। ফুটবল মরশুম শুরু হবে আগামী বছর মার্চের প্রথম সপ্তাহে। তার আগে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আয়োজন করা হবে আন্তঃক্লাব দলবদল। এদিনের জিবি বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সংস্থার প্রাক্তন সচিব দিলীপ রঞ্জন নন্দীকে আজীবন সাম্মানিক সদস্য পদ দেওয়া হবে। সেইসঙ্গে প্রশান্ত কুমার বোস কেও আজীবন সদস্য পদ (পেইড) দেওয়া হবে। বৈঠকে আরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় শহরের দুই ক্লাব মধ্য শহর সাংস্কৃতিক সংস্থা এবং তরুণ সংঘ কে ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হবে। এছাড়াও পূবালী ও গণসুরকে ২৫ হাজার টাকা করে সংস্থার পক্ষ থেকে দেওয়া হবে। টাউন ক্লাব কে ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
জি বির বৈঠকে নেওয়া অন্যান্য সিদ্ধান্তগুলি হচ্ছে- আগামী এক মাসের মধ্যেই সংস্থায় প্রয়াত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা মুখ্য পৃষ্ঠপোষক সন্তোষ মোহন দেবের মূর্তি বসানো হবে।
সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছর ২১ ফেব্রুয়ারি সংস্থার নবনির্মিত লাইব্রেরী ও আর্কাইভ এর উদ্বোধন করা হবে। এর ৯০% কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। বাকি শুধু ১০ শতাংশ।
গোটা ইনডোর হলে বসানো হবে নতুন টার্ফ। এর জন্য ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি কোম্পানির সঙ্গে আলাপ আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে একটির সঙ্গে কথাবার্তা অনেকটাই এগিয়ে গেছে। এই কাজের জন্য ৫ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকার একটা বাজেট জিবি বৈঠকে অনুমোদন পেয়েছে। তবে নতুন টার্ফ বসাতে দরকার প্রায় ৯ লক্ষ টাকা। তাই বাজেটের বাকি টাকাটা সংস্থা জোগাড় করে নিলেই কাজ শুরু হয়ে যাবে। ইনডোরে নতুন টার্ফ বসে গেলে টেবিল টেনিসের প্রশিক্ষণ ও সেখানে করা যাবে।
জিবি বৈঠকে সংস্থার পাঁচজন স্থায়ী কর্মচারীর বেতন বৃদ্ধির বিষয় ও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
Comments are closed.